রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর। বাজেটের অর্থপ্রাপ্তির সবচেয়ে বড় খাতও এটি। রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আদায়কৃত রাজস্বের বড় অংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে, যার পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের পরিমাণ ৩০ শতাংশ | অথচ মালয়েশিয়ায় প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ ও ভারতে ৫৬ শতাংশ৷ আগামী অর্থবছরের বাজেটে আয়কর খাতে কিছু পরিবর্তন আনার ঘোষণা থাকলেও প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করার মতো কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
পরোক্ষ কর আসে মূলত মূসক (ভ্যাট) ও অন্যান্য শুল্ক থেকে, আর প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর আসে মানুষের আয়ের ওপর আরোপিত কর ও ভ্রমণ কর প্রভৃতি থেকে। একটি দেশে প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের পরিমাণ বেশি হওয়াটা মোটেও গণতান্ত্রিক নয়। এতে বোঝা যায়, সে রাষ্ট্রে যাঁদের আয় বেশি, তাঁরা কম কর দেন; আর যাঁদের আয় কম, তাঁরা কর দেন বেশি। প্রগতিশীল করব্যবস্থায় একটি দেশে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ মোট আদায়কৃত করের প্রায় ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রকাশনাতেই এ কথা বলা হয়েছে। দেশে পরোক্ষ করের মধ্যে ভ্যাটের হার অনেক বেশি, ১৫ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তা ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১২ শতাংশ এবং জাপানে ৫ শতাংশ। সমস্যাটা আয়কর হারে নয়, তা আদায়ের ব্যবস্থাপনায়৷ আইনেও কিছু সমস্যা আছে৷
বিত্তশালীরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন৷ আর সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রাজস্ব বোর্ড করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে রাজউক, সিডিএ, কেডিএ, আরডিএর আওতায় ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ও ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রেও টিআইএন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের আওতাধীন এলাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ, ভাড়ায় চালিত যানবাহন নিবন্ধন বা নবায়নের ক্ষেত্রে টিআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করাসহ আরও বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এদিকে যাঁদের টিআইএন নেই, তাঁদের ব্যাংক স্থিতি ও সুদের ওপর অতিরিক্ত ৫ শতাংশ করারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজস্ব বোর্ড। অর্থাৎ যাঁদের টিআইএন আছে, তাঁরা আগের ১০ শতাংশ হারেই উৎসে কর দেবেন, আর যাঁদের টিআইএন নেই, তাঁদের ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হবে। ফলে যাঁদের আয় করযোগ্য নয়, সেই মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ওপর তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২-১৩ অর্থবছরের বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে মাত্র পাঁচ হাজার ৬৬২ জন ব্যক্তি তাঁদের সম্পদের পরিমাণ দুই কোটি টাকার ওপর দেখিয়েছেন। এই পরিসংখ্যানটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্য কথায়, হাস্যকর৷ কোটি টাকার ওপর সম্পদ থাকলে করের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মাশুল দিতে হয়। সে কারণে বিত্তশালীরা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকির করেন। ব্যাংকঋণ ও গািড়-বািড় কোম্পািন থেকে প্রাপ্ত দেখিয়ে তাঁরা কর ফাঁকি দেন। বিশেষত, ঢাকা নগরের বাড়িওয়ালারা কর ফাঁকিতে সবচেয়ে এগিয়ে। অনেক বাড়িওয়ালাই ভাড়া বাবদ মাসে দুই-তিন লাখ টাকা উপার্জন করলেও এই আয়ের ওপর কর দেন না। এমনকি বিপুলসংখ্যক বািড়ওয়ালার টিআইএনই নেই। এবার অবশ্য বাজেটে বািড়ভাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের জন্য বলা হয়েছে। তবে তা কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। বািড়ভাড়া আইনে ভাড়া বাবদ ভাড়াটেকে রসিদ দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ বািড়ওয়ালাই তা মানেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকেরাও কর ফাঁকিতে পিছিয়ে নেই বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কর ফাঁকি দেওয়া ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে৷ বলা যায়, সার্বিকভাবেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে৷ আইন মেনে কাজ করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়৷ লেখকের পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁর আয়ের ওপর যা কর আসে সেটা দিতে গিয়ে বিপত্তির মুখে পড়েন৷ রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীরা তাঁকে বলেন, এত টাকা কেন কর দেবেন৷ আমাদের কিছু দিন, আমরা আপনার করের পরিমাণ অর্ধেক করে দেব৷ তিনি নিজের প্রকৃত কর দিতে নাছোড়বান্দা হওয়ায় এ নিয়ে তাঁকে ঘুরতে হয়৷
করপোরেট করের হার বাংলাদেশে অনেক বেশি হলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী মোট প্রাপ্ত করে কোম্পািন করের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ‘ডাবল বুককিপিং’ অর্থাৎ এনবিআরের জন্য একটি হিসাব ও নিজেদের জন্য আরেকটি হিসাব সংরক্ষণ করে থাকে। এ কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার প্রবর্তিত ও নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারের মাধ্যমে যদি সব নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের হিসাব সংরক্ষণ করা যেত, তাহলে এই ফাঁকি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হতো।
ব্যাংক ও বিমার করপোরেট করের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৫ ও মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর জন্য তা ৪৫ শতাংশ হলেও সম্প্রতি তৈরি পোশাক খাতের কোম্পানির জন্য উৎসে কর দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এই উৎসে কর চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বছর শেষে ওই উৎসে কর ওই কোম্পািনর ১০ শতাংশ কর হিসেবে গণ্য করা হয়। পোশাক ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে তাঁদের পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন না। অথচ সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তাঁরা এসব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। পোশাক কারখানার মালিকদের বিলাসব্যসনের কথা আমরা সবাই জানি। ফলে এ খাতের কর বাড়ানোর বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা দুই লাখ ৪০ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এটা হলে অনেকেই কিছুটা স্বস্তি পাবেন, সন্দেহ নেই। সমাজে আয়বৈষম্য কমাতে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। আমজনতার কর্মসংস্থানেও রাষ্ট্রের ভূমিকা নগণ্য৷ মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজেদের বন্দোবস্ত করে নিচ্ছে, যে যেভাবে পারছে। ফলে সমাজে অপরাধ ও নৈরাজ্য বাড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের পরিমাণ অন্তত সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। মানুষের আয়ের বৈষম্য কমাতে তাই প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই৷
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক৷