‘প্রশাসন সময়মতো এলে গ্রামটা পুড়ত কি’

স্থানীয় বিক্ষোভকারীদের নিয়ে মাঝির পাড়ার উত্তর কোণে ব্যস্ত থাকার সময়েই আরেক দল তরুণ জড়ো হয় দক্ষিণের ইট বিছানো রাস্তায়। আগুন দেওয়া হয় হিন্দুপল্লিতে।

সাম্প্রদায়িক হামলায় পুড়ে যাওয়া মাথা গোঁজার ঠাঁই নতুন করে তৈরিতে ব্যস্ত বাসিন্দারা। গতকাল দুপুরে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুর এলাকায়ছবি: আলতাফ হোসেন

বুধবার দুপুর ১২টা থেকেই বৃষ্টি রংপুরের পীরগঞ্জে। ভ্যানে করে ঘটনাস্থল মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুরে পৌঁছাই। পাড়ার পাশে সরু আখিরা নদীর ওপর বাঁকা সেতু। তা পার হলেই বাঁয়ে বটেরহাট আরডিএস দাখিল মাদ্রাসা। সেখানে তখন চলছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দের ত্রাণ বিতরণ। মাদ্রাসার পরেই বটের হাট। সেখানে কথা হয় ফাতা আর্মির সঙ্গে।

সাবেক সেনাসদস্য মো. ফাতাহ মিয়া স্থানীয়ভাবে ফাতা আর্মি নামে পরিচিত। তিনি বলেন, ‘সময়টা মাগরিবের পরপর। এর ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে ওসি সাহেব পুলিশ নিয়া আসেন। এর মধ্যে সাদেক চেয়ারম্যানও (রামনানাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাদিকুল ইসলাম) চলি আসছে। পুলিশ হবে ১০-১৫ জন। হিন্দু পাড়ার লোক আমার আগেও পুলিশকে ফোন দিচ্ছিল।’

পাশ থেকে তখন কথা বলে উঠলেন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের উপজেলা সভাপতি বিপুল সরকার। তিনি জানালেন, এখানে কিন্তু হামলা হতো না। অনেকের সঙ্গেই তাঁরা যোগাযোগ করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান, থানার ওসি আসারও দুই-আড়াই ঘণ্টা পরে হামলা হয়। তাঁর প্রশ্ন, এতক্ষণে কি রংপুর থেকে ফোর্স আনানো যাইত না? তাইলে কি এত ক্ষতি করা সম্ভব হতো? পাশে দাঁড়ানো ক্ষতিগ্রস্ত মাঝিপাড়ার মানুষের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কও তো ভাই, প্রশাসন সময়মতো এলে এই গ্রামটা পুড়ত কি?’

এক কিশোরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত রোববার রাতে পীরগঞ্জের মাঝিপাড়া গ্রামের বড়করিমপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি গবাদিপশু, স্বর্ণালংকার ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী লুট করা হয়। এর আগে ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে দুপুর থেকেই মাঝিরপাড়া গ্রামে উত্তেজনা দেখা দেয়।

আগুন ও ভাঙচুরের শিকার হওয়া প্রায় ২০টি বাড়ি ঘুরে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে প্রায় সবার কাছে শোনা গেছে একটি কথা যে বিকেল থেকে পুলিশকে জানানো হলেও তারা দেরি করল কেন? স্থানীয় থানার সাড়া না পেয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা ৯৯৯–এ ফোন দেন। তারপর পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্রের নেতৃত্বে এক জিপে করে পুলিশ আসে।

অবশ্য ওসি সরেস চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া কিশোরের বাড়ির এলাকায় পুলিশের ১৫–১৬ জন সদস্য নিয়ে তাঁরা অবস্থান করছিলেন। এরই মধ্যে হিন্দুপল্লিতে হামলা হয়।

বিক্ষোভ প্রতিরোধে চেষ্টাও ছিল

মাঝিপাড়ায় বিক্ষোভস্থল থেকে হামলাস্থল হিন্দুপল্লির দূরত্ব ২০০-৩০০ গজের মতো। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেলে ফাতা আর্মি তাদের সামলানোর চেষ্টা করেন। পরে একে একে ইউপি চেয়ারম্যান সাদিকুল ইসলাম, ইউএনও বিরোদা রানী রায়, নবনিযুক্ত এসি ল্যান্ড খায়রুল ইসলাম বিক্ষোভস্থলে আসেন।

দক্ষিণপাড়ার নলিন বাবু (৭০) বলেন, ‘শরীফল মেম্বার পা–ও পর্যন্ত ধরিছে, বলিছে, এটা কী পাইসেন তোমরা, একজনার অপরাধে আরেকজনাক ক্যান হামলা করিবেন।’ চেরাগপুরের আজু মাস্টারকেও বিক্ষোভকারীদের প্রতি বলতে দেখা যায়, ‘কোনো ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। যাঁই দোষী, তাঁক আমরা বিচার করব, আপনারা চলি যান।’

ফাতা আর্মি ওরফে মো. ফাতাহ মিয়া বলেন, ‘৫০০ লোককে আমি একাই আটকাইছি প্রথমে। বিকালে নাতিসম্পর্কের মাহমুদ ফোন করি জানাইল, ফেসবুকে স্ট্যাটাস থাকিয়া মাঝিপাড়ায় গন্ডগোল বাধছে। লুঙ্গি পরা আমি। মোটরসাইকেল নিয়া তখনই দৌড়ি আসিলাম। মাঝিপাড়ার সামোনে আসিয়া মোটরসাইকেল রাস্তায় আড়াআড়ি করিয়া বেড় দিলাম। তাদেক বললাম, কী হইছে, তোরা কি আমার এলাকার লোক, কী করবার নাগিছিস?’

ওরা বলল, ‘ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিছে, তাকে ধরা লাগবে।’

আমি বললাম, ‘আইন হাতে তুলি নেওয়া যাবে না। তোমাদের এখানেই থামতে হবে। এই করি করি ৪০০-৫০০ লোক জড়ো হই গেছে। সব আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোক, আমাকে মারি তারা পার হইতে পারতেছে না। ওই মুহূর্তে সরেসচন্দ্র ওসি সাহেবকে ফোন দিলাম। ফোন ব্যস্ত পাইলে এসআই ইসমাইলকে ফোন দিলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে ওসি সাহেবকে তথ্য পাস করি দিছে।’

আগুন নেভাতে বালতিই ভরসা

মাঝিরপাড়া গ্রামের ক্ষীতিশচন্দ্র দাস (৬০) বলেন, ‘আমি ও পরিবার ঘরে আটকা। বাইরে থেকে আগুন দেয়। প্রশাসনের লোক বালতি-ডেকচি দিয়া আগুন নেভায়।’ একই কথা বলেন বৃদ্ধ রুহিনীচন্দ্র দাসও। তিনি না পালালেও তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূ ধানখেতে পালান। পরে তাঁরাও বালতি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।

পীরগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা রতন চন্দ্র শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, রাত তিনটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ততক্ষণে সব শেষ। পীরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের হিসাবমতে আগুনে পুড়েছে ১০টি ঘর, ভাঙচুর করা হয়েছে ১৯টি। একটি মোটরসাইকেল, দুইটি অটোভ্যান ও পানির মোটরসহ অন্তত সাতটি ঘর ও তিনটি মুদিদোকানের সকল সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বিক্ষোভ স্থানীয়, হামলাকারীরা বহিরাগত?

১৭ অক্টোবর (রোববার) দিনটা ছিল হাটবার। এর আগে ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগের জের ধরে দেশের কয়েকটি স্থানে প্রতিমা ও মন্দির ভাঙচুর এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে। কুমিল্লার ঘটনার চার দিন পর ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে হাটবারে পীরগঞ্জের রামনানাথপুর ইউনিয়নের মাঝিরপাড়ার গ্রামে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বিচ্ছিন্ন হিন্দু গ্রাম মাঝিপাড়ার বড়করিমপুর। এক পাশে আখিরা নদী, তিন দিকে ধানখেত ও বিল। খেত ও বিলের পরে সব দিকেই মুসলমান গ্রাম। রোববার সকাল থেকেই ওই কিশোরের নামে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। হাটবার বলে লোকসমাগম বেশি। কিন্তু স্থানীয়রা খেয়াল করেন অচেনা যুবকদের আনাগোনা। বিকেলের দিকে তা বাড়তে থাকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা ও স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলেছেন, পাশের থানা পলাশবাড়ী থেকে মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যানে করে দাঙ্গাবাজেরা এসেছে। তবে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনজন এবং পরের দুদিনের অভিযান চালিয়ে মোট যে ৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, তারা সবাই পীরগঞ্জের। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে স্থানীয় আবদুল্লাহপুরের আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান ওরফে লাবুও আছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘অভিযুক্তদের মধ্যে নিরীহও রয়েছেন।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন অভিযুক্তকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

স্থানীয় নেতা, ভুক্তভোগী ব্যক্তিরাসহ বড়করিমপুর গ্রামের অন্তত ২০ জন এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারী ও হামলাকারীরা এক নয়। হামলাকারীরা বহিরাগত বা আশপাশের গ্রামের, তাদের চেনা যায়নি। বিক্ষোভকারীদের থামানো গেলেও হামলাকারীদের থামানো যায়নি। এমনকি লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিরাও আশপাশের গ্রামের লোক বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য ও কয়েকজন আক্রান্ত ব্যক্তি।

নাশকতার ব্যাকরণ

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল থেকে সন্ধ্যায় যারা ফেসবুকে ইসলাম অবমাননাকারীর গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করছিল, তারা আশপাশের তিন গ্রামের লোক। পুলিশ, চেয়ারম্যান, সমাজপতিদের চেষ্টায় রাত ৯টার দিকে তারা শান্ত হয়। জমায়েত-পুলিশ-সামাজিক নেতারা ছিলেন মাঝিপাড়ার উত্তর দিকে অভিযুক্তের বাড়ির কাছে। কিন্তু হঠাৎ দক্ষিণ মাঝিপাড়ার দিকে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। ফাতাহ মিয়া বলেন, ‘পুলিশ ও জনবল কম থাকায় আমরা সেদিকে যেতে পারিনি।’

প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসী গুরুচরণ দাস (৬০) সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘বাড়িত ভাত বাড়ি দিছে। সেই ভাতও খাইতে পারিনি। বাড়িত আমি, ছোট ব্যাটা ও শাশুড়ি। আমি ওনাকেও নিতে পারিনি, ব্যাটাক নিয়ে গিয়া লুকাইছি…তখন চারোপাশে দিয়া লোক আসতিছে। সব রোড বোলাক (বন্ধ)।’

সুমনচন্দ্র দাসের প্রশ্ন, ‘ফেসবুকে পোস্ট দিছে সকালে, লোক জড়ো হলো বিকালে। এত কম সময়ের মধ্যে তো পরিকল্পনা করা ছাড়া এটা ঘটবে না!’

স্থানীয় বিক্ষোভকারীদের নিয়ে পাড়ার উত্তর কোণে ব্যস্ত থাকার সময়েই আরেক দল তরুণ জড়ো হয় দক্ষিণের ইট বিছানো রাস্তায়। স্বপনচন্দ্র সরকার বলেন, ‘রাত সাড়ে আটটার পরে তারা আসে। সবার মুখে মাস্ক পরা। নেশাগ্রস্ত আধুনিক ছেলেপেলে। বয়স ২০-৩০–এর মধ্যে। আমার বাড়িতে লুটপাট করে প্রায় ৩০ জন।’

পাহারা ছিল অভিযুক্ত ফেসবুক পোস্টদাতার বাড়ি ঘিরে। সন্ধ্যার পরপরই পুলিশ ওই পাড়ার সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে রাখে, ‘যাতে ওরাও কিছু করতে না পারে, বাইরের লোকও তাদের কিছু করতে না পারে’, বলেছেন স্বপনচন্দ্র সরকার।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়

হামলা শুরুর ঠিক আগে আগে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কথা বলেছেন গ্রামবাসী ও প্রতিরোধে শামিল মানুষ। সুমনচন্দ্র দাস বলেন, ‘যখন চেয়ারম্যান আটকাইছে (মিছিলকারী লোক), পাঁচ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট (বিদ্যুৎ) চলে গেছে। হামলা হয়েছে দুই পাশ থেকে। ককটেল ফুটাইছে, পেট্রল দিয়ে জ্বালি দিছে ঘর, খড়ের পালা, সব। বলছে, “হিন্দুদের পুড়ায়া ফালাও, সাইজ করো।” আমার বড় ভাইরে ধরলে উনি বলছেন, “আমি মুসলিম”। তখন বলে “কলেমা পড়”। কলেমা পারে নাই, তখন পিটাইলে উনি দৌড় দেন।’ সেটা ছিল চাঁদনিরাত। চাঁদের আলোয় মাস্ক পরা অনেকেরই মুখ চেনা না গেলেও বাড়িঘরগুলোকে নিশানা করতে অসুবিধা হয়নি হামলাকারীদের।