ব্যবসাবান্ধব বাজেট ও ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতির’ তত্ত্ব

ঘোষিতভাবে জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটি প্রজাতন্ত্রের ৫০তম বাজেট। বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

এ কথা সত্য যে বাজেট প্রণয়নের সময় আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতে হয়, অন্যদিকে এটিকে একমাত্র নির্ণায়ক বিবেচনা করাও আবার সঠিক নয়। অর্থশাস্ত্র বলে, যে পরিমাণ অর্থই থাক না কেন, দেখতে হবে সেই স্বল্প পরিমাণ অর্থ সরকার কী পরিমাণ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম। মানুষের অভাবের শেষ নেই, তারপরও কোন অভাবকে প্রাধিকার বা প্রাধান্য দিতে হবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি। কোন খাতে কত খরচ করব, কেনইবা করব, সে সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকাও প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত বাজেটের রয়েছে মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ। এক. করোনার কারণে অর্থনীতি যে গর্তে পড়েছে, সেখান থেকে তুলে এনে তার গতি বাড়ানো। দুই. অর্থনীতিবিদেরা যাকে ইংরেজি ‘কে’ আকৃতির পুনরুদ্ধার বলছেন, সেই পথে হেঁটে প্রবৃদ্ধির ফল মাত্র একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়ে বাকিদের এর সুফল থেকে বঞ্চিত রাখার শঙ্কা এড়ানো। এ লক্ষ্য দুটি কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়। তবে বিবেচনায় রাখতে হবে দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটলেই করোনার কারণে ব্যক্তি আয়ের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া যাবে, তা নয়। তবে যা হারিয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের পথে ফেরার একটি প্রধান শর্ত এটি। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দুটি লক্ষ্য হওয়া উচিত। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে সংকোচন হয়েছে, তা যতটা দ্রুত পারা যায় কাটিয়ে ওঠা আর প্রবৃদ্ধির হার যাতে দ্রুততর হয়, সে লক্ষ্যে কর ও প্রণোদনাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো।

যখন অর্থনীতি অনেকটা সংকুচিত, তখন বাজেটের আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্বঘাটতি আর বাস্তব চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা। রাজস্বঘাটতি বৃদ্ধির চাপ সামলে নিয়ে প্রবৃদ্ধির পথে এগোতে হবেই।

অন্য বেশির ভাগ দেশ যখন মহামারির শুরুতেই ব্যয় বাড়িয়েছিল, স্বল্প রাজস্ব আয়ের বাংলাদেশ কিন্তু তখনো অনেকটা চিরচেনা পথেই হেঁটেছে।

এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়িয়ে অর্থনীতির গতি বাড়ানো যায়। চ্যালেঞ্জ যে শুধু করব্যবস্থা আর খরচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়; বিদ্যালয়গুলো দীর্ঘকাল ধরে বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা প্রায় দেড় বছর ধরে শ্রেণিকক্ষে বসে প্রত্যক্ষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ডিজিটাল বা অনলাইন ক্লাস যে প্রত্যক্ষ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পরিপূরক হতে পারেনি, তা মোটামুটি সবাই মেনে নিয়েছে। শিক্ষার এই ঘাটতি পূরণ করাও এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই মনে করছেন, এর প্রভাব এখনই বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতে যখন এসব ছাত্রছাত্রী চাকরির বাজারে আসবে, তখন বোঝা যাবে আমরা কী হারিয়েছি।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপরে বাজেটে নতুন করে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সত্য হচ্ছে, গত ১৫ থেকে ১৬ মাসে সরকারি সুবিধার মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রকমে টিকে থাকলেও সুবিধার বাইরে থাকা বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় এই করারোপের প্রস্তাব নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশ্বাস।

এবার আসা যাক স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। অতিমারি আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সুবিধা ও অসুবিধা, দুই-ই সামনে তুলে ধরেছে। এত দিনের অনেক ধারণাও অনেকটা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যেন সবার সামনে বেশ নাজুক হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। তাই শুধু নৈমিত্তিক ব্যয় বরাদ্দের প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য খাতের জন্য নতুন কৌশল হাতে নিতে হবে।

এটি প্রায় স্বীকৃত যে সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানই প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা কীভাবে হবে, বাজেটে কিন্তু বলা হয়নি। নানা কারণেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে প্রায় এক জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। ব্যাংকে না হয় আপাতত তারল্য আছে, তবে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকবহির্ভূত অন্যান্য খাত থেকে যে বিরাট অঙ্কের টাকা সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের কাছ থেকে তা কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, সেটাও অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া গত প্রায় দেড় বছরে অনেক সরকারি প্রকল্পে ধীরগতি দেখা গেছে। তাই শুধু টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নেও নজর রাখতে হবে।

করোনা অতিমারিতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে কৃষি-শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোরও কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার-বীজের ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি এসব উপকরণ ব্যবহার ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সম্যক ধারণা বাড়াতে বছরজুড়েই কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

বিভিন্ন জরিপ বলেছে, অতিমারিতে অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ছাড়া আছে অনেক বিত্তহীন মানুষ। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণের কথা বলা হলেও চাহিদার তুলনায় সেটি খুবই কম বলে অনেকেই বলছেন। তার মধ্যে আবার সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন আর সঞ্চয়পত্রের সুদও ঢুকে পড়েছে। তারপরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যারা সুবিধাভোগী, তাদের বাইরে অসংখ্য নিম্ন আয়ের ও গরিব মানুষ রয়েছে। তাদেরও সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা প্রয়োজন।

করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন স্বনিয়োজিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং তা গতিশীল করতে তরুণদের পুনর্বাসন ও বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন ছিল। দেশে রিকশাচালক, ছোট দোকানদার কিংবা এ ধরনের ছোট ছোট পেশায়ই কর্মসংস্থান বেশি ঘটে। এগুলোই অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি। তবে এদের বিপর্যয় কাটানোর জন্য কোনো প্রণোদনা গোচরীভূত হয়নি। সন্দেহ নেই, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে চাঙা করতে হবে। বৈদেশিক শ্রমবাজারও পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে তাঁদের ফেরত পাঠাতে হবে। যাঁদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না, তাঁদের জন্য দেশেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

অনেক অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, মন্দাকালে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি বলতে বেশির ভাগ সময়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বোঝায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের সঙ্গে স্বল্পকালীন ব্যয়ও থাকা বাঞ্ছনীয়। এ স্বল্পকালীন ব্যয়ে যেমন একদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দান-অনুদান থাকবে, অন্যদিকে এমন কিছু স্বল্পকালীন প্রকল্প থাকবে, যাতে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি হবে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ যাবে পরিকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায়। অধিকন্তু, দ্রুত আর্থিক পুনরুদ্ধারের জন্য গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে যেমন পরিকল্পিতভাবে ব্যয় বরাদ্দ প্রয়োজন, অন্যদিকে শহরাঞ্চলেও বিশেষ নজর দিয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, তথা নগর দারিদ্র্য বিমোচনে জোর দেওয়া আবশ্যক। বাজেট বরাদ্দে যেমন স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিশেষত জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, তেমনি অতিমারি-পরবর্তী সময়ে কাজের ধারা পাল্টানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তি বা অটোমেশনের প্রসার এবং সে-সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জনে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিও প্রয়োজন।

অনেকেই বলেছেন, বাজেট গতানুগতিক ধারায় চলছে। নির্মম সত্য হচ্ছে, ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরেই এ ধারা বিদ্যমান। অনেকে বাহ্যিকভাবে স্বীকার না করলেও এ ধারার নিয়ন্ত্রক দর্শন হচ্ছে ট্রিকেল ডাউন বা চুইয়ে পড়া অর্থনৈতিক তত্ত্ব। এতে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বা কর রেয়াত কিংবা ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অর্থ চুইয়ে চুইয়ে তথা পরোক্ষভাবে দরিদ্র বা নিম্নবিত্তদের হাতে চলে যাবে বলে মনে করা হয়। সেই মাধ্যমেই অর্থনীতিতে ভোগব্যয় বৃদ্ধি পাবে। আমাকে একজন প্রথিতযশা অর্থসচিব অনেক আগে বলেছিলেন, ‘একজন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাকে ৫০ কোটি টাকা দিলে তিনি যেভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারবেন, আপনি তা পারবেন না।’ আমি অবশ্য সাহস করে বলতে পারিনি, স্থানীয় প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করে বা ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে সত্যিকার উদ্যমী লোকদের কাছে টাকা পৌঁছে দিতে পারলে উপকার হয়তো আরও বেশি হতো। এই নিয়ন্ত্রক বিশ্বাসকে ধারণ করে ‘চুইয়ে পড়ার অর্থনীতি’ যত দিন চলবে, তত দিন আমরা হয়তো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাবান্ধব বাজেটই পাব, তার চেয়ে বেশি বা কম নয়।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।