ভাঙা হাত নিয়ে রাস্তায় আমেনা খাতুন

আমেনা খাতুন
ছবি: লেখক

ঘড়িতে তখন বেলা ১টা ৩০ মিনিট। বৈলাজান গ্রামের মসজিদে মুসল্লিদের নিয়ে জোহরের নামাজের জামাতে দাঁড়িয়েছেন ইমাম সাহেব। মসজিদ থেকে মধুর কণ্ঠে ইকামতের আওয়াজ ভেসে আসছিল। ওই পথ দিয়ে রোজ ফিরতে হয় প্রায় সময় আমাকে। বৈলাজান গ্রাম হয়ে ফিরছিলাম মোটরসাইকেলে। মসজিদের সামনের দিকেই পাকা রাস্তা নেমে গেছে কেশরগঞ্জ বাজার হয়ে সোজা পাটিরা বাজার পর্যন্ত।

রাস্তার পাশের মসজিদটা যখন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখন ‘বাবা’ বলে উচ্চ স্বরে ডাক দিলেন একজন। ডাকটা শুনে মুহূর্তেই গাড়ির গতি কমিয়ে কষে ব্রেকে চাপ দিলাম। পেছনে তাকাতেই দেখি, বয়সের ভারে একেবারেই ন্যুব্জ এক বৃদ্ধা হাত উঁচু করে ডাকছেন আমাকে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। ডাক শুনে সামনে গিয়েই দেখি, ভাঙা হাত নিয়ে রোদে বসে কয়টা টাকার জন্য আহাজারি করছেন তিনি। ‘আব্বা, কয়ডা টেকা দেন, হাতের বেদনায় বাঁচি না, চিকিৎসা করামু।’

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের কালারচরে বাড়ি বয়সের ভারে ন্যুব্জ ৯০–ঊর্ধ্ব আমেনা খাতুনের। তাঁর স্বামী মোসলেম ফকির আরেকটি বিয়ে করে মারা গেছেন বহু দিন আগে। রহিমা ও ফাতেমা নামের দুই মেয়ে আছে আমেনার। সতিনের সংসারে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন তিনি। অবশেষে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে সন্তানদের মানুষ করেছেন আমেনা খাতুন।

এক মেয়ে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন, সেখানেই বিয়ে করে স্বামী–সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। আরেক মেয়ে ফাতেমাকে তাঁর স্বামী তালাক দেওয়ার পর মায়ের সঙ্গে থাকেন। কোনো জমিজমা না থাকায় অভাবের সংসারে মাকে খাওয়াতে মেয়েও ভিক্ষা করেন।

সম্প্রতি ঘুম থেকে উঠে চৌকি থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে ডান হাতটা ভেঙে যায় আমেনা খাতুনের। পাঁচ মাস ধরে হাত ভেঙে পড়ে আছেন বৃদ্ধা আমেনা খাতুন। ভিক্ষা ছাড়া এক বেলা ভাত তাঁর কপালে জোটে না। আবার চিকিৎসা করাবেন কী দিয়ে, তাই ভাঙা হাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। ভাঙা হাতের চিকিৎসা করাতে পারছেন না টাকার অভাবে। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে ঢাকায় স্বামী–সংসার নিয়ে থাকলেও মায়ের অসুখের খোঁজ নেওয়ার সময় হয় না তাঁর। ছোট মেয়ে ফাতেমা অসুস্থ হয়ে পড়ায় দুটো ভাতের জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে তাই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভিক্ষা করছেন আমেনা খাতুন।
অশ্রুসিক্ত বৃদ্ধা আমেনা খাতুন বলেন, ‘স্বামী দুই বিয়া করায় সতিনের অত্যাচার সহ্য করছি। ভিক্ষা কইরা সংসার চালাইছি, অহন আর চলতে পারি না। চকি থেইকা নামনের সময় পইড়া যাইয়া ডাইন হাতটা ভাইঙ্গা গেছে, কবিরাজ দিয়া চিকিৎসা করলাম, কাম হইল না, হাতটা বেদনা করে। ওষুধ কিনতে পারতাছি না, ঘরে খাওন নাই, মেয়াডারও অসুখ। ডেনাডা (হাতটা) ভালা হইলে কোনোরহম চলতে পারতাম, অহন বাম হাত দিয়া সব কাম করতে হয়। আমার হাতের চিকিৎসার লাইগা কেউ যদি সাহায্য করত, আমি হয়তো আরও কয়ডা দিন নিজের কামডা আপাদত কইরা চলতে পারতাম। কত মেম্বার চিয়ারম্যানের দ্বারে গেলাম, কেউ আমার কতা হুনে না।’

ভাঙা হাত নিয়ে রাস্তায় বসে কাঁদছিলেন আমেনা খাতুন
ছবি: লেখক

আমেনা খাতুন আরও জানান, সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের কাছে চেয়েও একটি ভাতার কার্ড মেলেনি তাঁর কপালে। সরকার থেকে থাকার মতো একটি ঘর পেলেও সেই ঘরে খাবার নেই তাঁর। অন্যান্য সরকারি সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত বলে জানান আমেনা খাতুন।

আমেনা খাতুনের মতো এমন অনেকে আছেন, যাঁরা পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকেন। এসব বৃদ্ধ মানুষের জন্য সরকারের নানান সুযোগ–সুবিধা চালু থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে সুযোগগুলো থেকে বঞ্চিত থাকেন আমেনা খাতুনের মতো অসহায় হতদরিদ্ররা। এসব মানুষের কথা ভেবে সরকারের উচিত প্রান্তিক পর্যায়ের এ মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে বয়স্ক ভাতাসহ সরকারের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

*ইমতিয়াজ আহমেদ