ভ্লাদিমির পুতিনের ফাঁকা বুলি

স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক বার্ষিক ভাষণ হুমকি-ধমকিতে ভরা। মনে হয় তিনি যেন নিজেকেই আশ্বস্ত করতে চান। তিনি পশ্চিমাদের শুধু সীমা লঙ্ঘন করতেই নিষেধ করেননি, এ ঘোষণাও করেছেন যে সীমাটাও ঠিক করে দেবেন তিনিই। ভাবখানা এমন যেন রাজনীতিবিদ নন, বরাবরই তিনি একজন স্রষ্টা, অতীতে সীমা–পরিসীমা সব তিনিই নির্ধারণ করেছেন।

পশ্চিম নয়, মনে হচ্ছে যেন নিজের সঙ্গেই শক্তি পরীক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হাঙ্গেরিকেই সামলাতে পারে না, তার শক্তি রাশিয়ার জন্য হুমকি, পুতিনের এ ইঙ্গিত খুব কম লোকই বিশ্বাস করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায়ও এটি প্রযোজ্য। যদিও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন নতুন করে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রুশ সহায়তায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার চেয়ে এগুলো মনে হয় আরও বেশি প্রতীকী। নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে দুদিনের জন্য রুশ রুবলের মূল্য পড়ে গিয়েছিল, তারপরই দাম ধাই করে বেড়ে যায়।

এমনকি রাশিয়ানরাও পুতিনের হুমকির মধ্যে কোনো সারবত্তা খুঁজে পাবে না। তার মানে অবশ্য এই নয় যে তখনই তারা তাকে পদচ্যুত করতে ছুটবে (এই জাতীয় পদক্ষেপ সব সময় সমস্যাই সৃষ্টি করে, পরিণতিতে আরও খারাপ শাসনই ডেকে আনে)। ক্রিমিয়া দখলের পর রুশরা যেমনটা করেছিল, এবারও তারা তেমন প্রতিক্রিয়াই দেখাবে, এমন ইঙ্গিত কিন্তু সামান্যই পাওয়া যাচ্ছে। পুতিনের জনপ্রিয়তা সেবার ধাই ধাই করে বেড়ে গিয়েছিল।

তা ছাড়া ক্রিমিয়া এবং পূর্ব ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চল হরণ করে রাশিয়া বা তার জনগণের কোনো লাভ হয়নি। ইউক্রেনের ৭ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করে সেখানে আঞ্চলিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ক্রেমলিনকে এখন ভাড়াটে সৈন্যদের অর্থ দিতে হচ্ছে, গড়তে হচ্ছে বাড়তি অবকাঠামো (যেমন রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত বিশাল ব্রিজ) এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন ও কাজে অক্ষম স্থানীয় বাসিন্দাদের দিতে হচ্ছে ভাতা।

তার ওপর একসময় ইউক্রেনীয় সমাজে রাশিয়ার যে সুনাম ছিল, তা–ও সে হারিয়েছে, সম্ভবত চিরতরেই। ঐতিহাসিকভাবেই ইউক্রেনীয়রা রুশ সাংস্কৃতিক বলয়ে বিচরণ করত। (একই ধরনের সাংস্কৃতিক ‘বিচ্ছেদ’ এখন বেলারুশেও ঘটে চলেছে।) ইউক্রেনীয়রা রুশ টিভি দেখত, রুশ সংগীত শুনত, কিনত রাশিয়ান ভোগ্যপণ্য; খুব কমই, অন্তত কাইভের পূর্ব দিকের খুব কম লোকই নিজের ইউক্রেনীয় পরিচয় নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল। কিন্তু সবই বদলে গেছে। জাতিসত্তার আলোকে ইউক্রেনীয়দের এক করার কাজটা কোনো ইউক্রেনীয় রাজনীতিবিদই অতটা করতে পারেনি, যতটা করেছেন পুতিন।

রাশিয়ার আগ্রাসন নিজের সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারিত ও সংহত করার পথে ইউক্রেনকে চালিত করেছে, পশ্চিমের সঙ্গে গভীর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মিলনে তাদের তাড়িত করেছে এবং বাস্তবায়ন শুরু করেছে ঘরোয়া সংস্কার (যদিও ধীরগতি)। এমনকি ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলদোমির জেলেনস্কির মতো রুশপন্থী রাজনীতিবিদদের স্বাধীনতাসংগ্রামের নায়কে পরিণত করেছেন পুতিন। রুশ নেতার পরবর্তী অর্জন হবে সম্ভবত জেলেনস্কির ঝিমিয়ে পড়া দলের জন্য ভোট বৃদ্ধি, যার পরিণতিতে পুনর্নির্বাচিত হবেন তিনি। অথচ এই সেদিন পর্যন্তও এই ফলাফল ছিল অনিশ্চিত। রুশ সমর্থক বাহিনী যেন সমর্থন হারায় তা নিশ্চিত করেছেন পুতিন।

পুতিনের ক্রমবর্ধমান কৃতিত্বের তালিকায় আরও আছে চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করা। সম্প্রতি ৬০ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে তারা। ২০১৪ সালে চেক অস্ত্রগুদামে বিস্ফোরণের পেছনে ক্রেমলিনের হাত ছিল, এ তথ্য প্রকাশের আগপর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট মিলোস জেমান ছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে পুতিনপন্থী রাজনীতিবিদ আর তারও আগে প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বাবিজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর বিরোধিতা করেছিলেন। আর এখন তার সরকারি ক্রয়ের দরপত্র থেকে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন রোশাটমকেও বাদ দিয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র। আর তার সর্বশেষ তর্জন–গর্জনের পর ইইউতে রাশিয়ার তৈরি স্পুতনিক টিকা ব্যাপক হারে বিতরণের আশা ছাড়তে পারেন পুতিন।

তেমনি বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে জার্মানিতে রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের জন্য নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইনও এখন সুতায় ঝুলছে। সেপ্টেম্বরে জার্মানির ফেডারেল নির্বাচনের মধ্যে প্রকল্পটি যদি শেষ না হয়, তবে এটি ডুবুরিদের জন্য একটা পর্যটক আকর্ষণে পরিণত হতে পারে। জরিপে জার্মান গ্রিনরাই এখন এগিয়ে আর জার্মান প্রেস ও জার্মান সমাজ উভয়ই এই প্রকল্প বাতিল করতে চায়।

যদিও ইউক্রেনীয় সীমান্তে প্রায় দেড় লাখ সৈন্য, ভারী সরঞ্জাম এবং ফিল্ড হাসপাতাল মোতায়েনে রাশিয়ার ব্যয়ের সঠিক পরিমাণ আমরা জানি না, তবে সন্দেহ নেই এটি অর্থনীতির যথেষ্ট বড় একটি অংশ। রুশরা এ ব্যয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ১০ বছরের প্রকৃত মজুরি পতনের অভিজ্ঞতার পর নতুন করে পুতিনের অস্ত্র ঝনঝনানি খুব কম লোককেই উদ্দীপিত করবে।

অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। খুনখারাবির বদলে পুতিনের রাশিয়া আধুনিকায়নকে বেছে নিতে পারত। সোভিয়েত ইউনিয়নও প্রথম পথটি বেছে নিয়েছিল। আজকের রাশিয়া ক্রমেই শেষ দিককার ইউএসএসআরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সে সময়ে দেশটি শাসন করত কেজিবির আরেক লোক ইউরি অ্যান্ড্রোপভ। ১৯৭৯-৮৯ যুদ্ধে আফগানিস্তানে ইউএসএসআরের যা অর্জন, ইউক্রেনে ঠিক তাই অর্জন করেছে রাশিয়া।

রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এখন ঘোষণা করেছেন ইউক্রেনীয় সীমান্ত অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার শুরু করবে রাশিয়া। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পুতিনের ভাষণটি ছিল কথার ফুলঝুরি। এটা ইঙ্গিত করে দেশের ভেতরে ও বাইরে ক্ষমতা হারাচ্ছেন তিনি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

l স্লাভোমির সিয়েরাকোভস্কি পোল্যান্ডের ওয়ারশতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের পরিচালক