মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জিতবেন

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচনা চলছে। কে জয়লাভ করবেন? নির্বাচনে পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে মতামত জরিপ এবং সারা দেশ মিলে কে কত ভোট পাবেন, এ দুই বিষয়েই সারা বিশ্বের গণমাধ্যম সরব।

পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে, মতামত জরিপগুলো কাজ করেনি। ১৯৮২ সালে লস-অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র ব্রাডলি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ালে মতামত জরিপগুলো বলেছিল, তিনি বিপুল ভোটে জিতবেন। কিন্তু তেমনটি হয়নি। ‘ব্রাডলি ইফেক্ট’ মতামত জরিপকে সংশয়ে ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা যুক্তরাজ্যে মতামত জরিপের সঙ্গে প্রকৃত ফলাফলের ফারাক দেখা গেছে। দেশব্যাপী কে কত ভোট পেল, তার ভিত্তিতেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম ধারার দ্বিতীয় উপধারা অনুযায়ী ইলেকটোরাল কলেজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। সিনেটের ১০০ জন, প্রতিনিধি পর্ষদের ৪৩৫ জন সমতা বিধান করে ও ২৩তম সংশোধনীর আলোকে ওয়াশিংটন ডিসির ৩ জন ধরে মোট ৫৩৮ জন ইলেকটোরাল কলেজ প্রতিনিধি। এ নিয়মের গণতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফেডারেল পদ্ধতির হওয়ায় বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন বিধি-বিধানের কারণেও অনেকে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারেন না।

এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকে একটি রাজনৈতিক জনমিতি মডেল উপস্থাপন করে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাতটি নিয়ামক বিশ্লেষণে করা হয়েছে।

প্রথমত, লাতিন আমেরিকার সাদা বর্ণের মানুষ বাদ দিলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সাদাদের সংখ্যা কমছে। সাদা বর্ণের জনগণ ১৯৯৬ সালের নিবন্ধিত ভোটারের ৮৫ শতাংশ থেকে কমে ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য বর্ণের ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে। কালো বা আফ্রিকান আমেরিকানরা ১১, লাতিনরা ৮ আর পুরো এশিয়া অঞ্চলের বংশোদ্ভূতরা মোট ভোটারের ৬ শতাংশ। সাদা ভোটারের সংখ্যা আপেক্ষিকভাবে কমলেও নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে নিয়ামক।

১৯৩০-এর দশক থেকেই ডেমোক্রেটিক পার্টির বড় আবির্ভাব। রুজভেল্টের উত্থানকালে কালোরা খুব কমই ছিল। কালোরা ১৯৬০ সাল থেকে অর্থাৎ সিভিল রাইটস আন্দোলনের কাল থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন, এখন অধিকাংশ কালো এ দলকে সমর্থন করেন। এককালে তাঁদের পার্টি তথা আব্রাহাম লিঙ্কনের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টিই ছিল। এটা মার্কিন রাজনীতির বড় বাঁক।

দ্বিতীয়ত, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে থাকলেও বিরাট অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না, যা নিবন্ধিত ভোটারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৫ শতাংশ)। বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়া সাদা বর্ণের নিবন্ধিত ভোটারসংখ্যা ১৯৯৬ সালে ছিল ৪৫ শতাংশ, এটা কমে ৪১ শতাংশ হয়েছে। একসময় অধিকাংশ শিক্ষিতরা রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক হলেও এ অংশটিই সাম্প্রতিক কালে ডেমোক্রেটিক ভোটার।

তৃতীয় বাঁক দেখলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে; ৪৪ শতাংশ থেকে ৫০-৫২ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে যুবকেরাও বেড়েছেন, যদিও ভোটদানে তাঁদের উৎসাহ প্রবীণদের চেয়ে কম। প্রবীণ সাদাদের রিপাবলিকান পার্টির দিকে ঝোঁক থাকলেও করোনাক্রান্তি তাঁদের বড় বেগ দিয়েছে।

অন্যদিকে তরুণেরা সবার জন্য স্বাস্থ্য বা বিনা খরচে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেওয়ার সুযোগের ব্যাপারে সোচ্চার। মার্কিন সমাজে ম্যাকার্থিজমের কশাঘাতে সমাজতন্ত্র ট্যাবু হলেও তরুণদের মধ্যে বামপন্থী প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ভোটদানে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।

চতুর্থত, আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্মের সঙ্গে বিয়োগের কথা বলা হলেও ভোটে ধর্ম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬০-৬৪ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। এদের ইভাঞ্জেলিকেল ভোটার ২১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ শতাংশ হলেও এঁদের ট্রাম্পের সমর্থন ঘাঁটি হিসেবে ধরা হয়।

পঞ্চমত, ভৌগোলিক বাঁক সব সময়ই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূগোল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সানবেল্ট অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যগুলো যেমন আরিজোনা, জর্জিয়া বা টেক্সাস এবং রাস্টবেল্ট বা নিউইয়র্কের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো যেখানে বড় বড় শিল্প স্থাপনা ছিল কিন্তু এখন বি-শিল্পায়নের পথে চলেছে যেমন মিশিগান, উইসকসিন বা পেনসিলভানিয়া রাজ্যগুলোর পরিবর্তিত পরিস্থিতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।

ষষ্ঠত, সাধারণত নারীরা পুরুষের চেয়ে ভোটাধিকার বেশি প্রয়োগ করেন। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রেও বয়স, বর্ণ, শিক্ষা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রূপ নারী আন্দোলনে প্রভাব ফেলেছে। একইভাবে উপশহরের নারীদের নিয়ে কথাবার্তা তাঁদের বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে।

সপ্তমত, বড় ধরনের সংকট নির্বাচনে বিশাল প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে পরিসংখ্যান বলে, নির্বাচনকালের প্রধানতম বিষয় জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে। যেমন ১৯২৮ সালে মানবতাবাদী হার্বার্ট হুবার ৪৪৪টি ইলেকটোরাল কলেজে বিরাট বিজয় পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিভিন্ন কমিশন করেছিলেন; জনগণ পছন্দ করেছিলেন।

কিন্তু চার বছর পরই ১৯৩৬ সালে নিউইয়র্কের গভর্নর ফ্রেডরিক ডি রুজভেল্ট ৪৭২টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছেন। হুবার মাত্র ৫৯ ভোট পেয়েছিলেন। ‘নিউ ডিল’ বাস্তবায়ন করে রুজভেল্ট চারবার প্রেসিডেন্ট হয়ে রেকর্ড করেছিলেন। ২২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দুই মেয়াদে সীমিত করা হয়েছে। একই রকম ঘটনা ঘটেছে ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রিগ্যানের ক্ষেত্রে এবং ২০০৮ সালে বারাক ওবামার বেলায় রংধনু কোয়ালিশনের মাধ্যমে।

সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের প্রধানতম ইস্যুর সঙ্গে ভোটে জেতার সম্পর্ক আছে। মহামন্দার সময় যেমন বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, চলমান অতিমারিও মানুষের জীবন ও জীবিকায় তেমন পরিবর্তন এনেছে। ইতিহাস এবং আলোচ্য মডেলের সাতটি নিয়ামকের আলোকে বলা যায়, ট্রাম্পের জন্য ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। যদি মার্কিনরা বর্তমান অতিমারির আলোকে মনে করেন নতুন ধরনের রাজনীতি লাগবে এবং ট্রাম্প তা দিতে পারবেন না, তাহলে ট্রাম্প নির্বাচিত হবেন না।

নির্বাচনে জয় নির্ধারণের মূল নিয়ামক হলো নতুন পরিস্থিতির আলোকে নতুন রাজনীতি। মার্কিনরা নতুন রাজনীতিকে স্বাগত না জানালে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হবেন। বাইডেনকে অনেকেই পছন্দ করেছেন না। রিপাবলিকানসহ সনাতন ধারার অনেকেই তাঁকে পছন্দ করছেন। ট্রাম্পের সময় রিপাবলিকান দল কনজারভেটিভ অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছে।

যেমন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে স্থিরতার অভাব দেখা যাচ্ছে এবং অনুপস্থিতিও দৃশ্যমান। বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ইউনেসকো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজদের গুটিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকা নিজেদের সাংবিধানিক আদর্শ, নিয়ম-নীতি, চেতনা এবং শিক্ষা বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটানো থেকে পিছিয়ে পড়েছে। সংবিধানভিত্তিক কূটনীতি আগের মতো কাজ করেছে না। এ প্রেক্ষাপটে সনাতনীদের অনেকেই ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন।

বাইডেন পৃথিবীতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবেন, তা নয়। তবে রংধনু কোয়ালিশন করতে পারলে এবং জনগণ তাঁদের মূল ইস্যু দ্বারা পরিচালিত হলে এ নির্বাচনে বাইডেনের জেতার সম্ভাবনা আছে। বাইডেন নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক চেতনার আলোকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার, জবাবদিহি, গণতন্ত্র এবং বহুপক্ষীয়তা ও বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের কার্যক্রম প্রসারের দিকে ঝুঁকবে। এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে।

একপক্ষ পূর্বাবস্থা বজায় রাখার পক্ষ নিতে পারে। অন্যপক্ষ ভারতকে বিশেষতা দান করে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগকে আলাদা আলাদা ক্লাস্টারে ভাগের যুক্তি দেখাতে পারে। একই সঙ্গে জনমনে প্রচলিত তথাকথিত বাংলাদেশকে ভারতের চোখ দিয়ে দেখার বলয় থেকে বেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের ভূকৌশলগত গুরুত্বের আলোকে আলাদা করে দেখার যুক্তিও দিতে পারে। এসব বাস্তবে জানার জন্য নির্বাচনের ফলাফল ও তৎপরবর্তী কার্যকলাপের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেশের স্বার্থে নিযুক্ত হতে হবে।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণে’র চেয়ারপারসন

[email protected]