মিথ্যাচারিতা সব অপকর্মের মূল

ইসলামে মানবজাতিকে সর্বাবস্থায় মিথ্যাচারিতা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া বা দোষারোপ করা, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ভেজাল কারসাজিসহ মানুষকে ঠকানোর যত রকম অপরাধ আছে, রমজান মাসে দেহ-মন থেকে তা যেন সর্বাবস্থায় নির্বাসিত হয়, সে জন্য রোজাদারদের মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। মিথ্যাচার হচ্ছে অসত্য কথা বলা, অসত্য সংবাদ দেওয়া, অবাস্তব বর্ণনা ও অসত্য তথ্য প্রদান। মিথ্যাচার একটি ঘৃণ্য বদস্বভাব। মিথ্যাচার মানুষকে কলঙ্কিত ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে তার জন্য ক্ষতি বয়ে আনে। ইহকাল ও পরকালে তাকে ধ্বংস করে দেয়। এ জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা মিথ্যাচার বর্জনের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো।’ (সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩০)
প্রকৃত রোজাদার মিথ্যাচারী ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে না, তাকে ভালোবাসে না, তার ওপর আস্থা স্থাপন বা নির্ভর করতে পারে না। তাই মিথ্যাবাদী যখন কোনো বিপদ-আপদে বা সমস্যায় পতিত হয়, তখন তাকে রক্ষা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। মিথ্যাচার মানুষকে অন্যায় ও অসৎ পথে পরিচালিত করে এবং তার জীবন কষ্টদায়ক করে দেয়। মিথ্যাবাদিতা মানুষকে অপকর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে। ফলে সে জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত থেকে অন্তরকে কলুষিত করে তোলে। মিথ্যাচারের কারণে রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই রমজান মাসে রোজাদারদের মিথ্যাচার বর্জনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘অবশ্যই তোমরা মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকবে, কেননা নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা অপকর্মের দিকে পরিচালিত করে এবং অপকর্ম দোজখের দিকে পরিচালিত করে। আর যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলতে থাকে ও মিথ্যার অনুসন্ধান করতে থাকে, সে অবশ্যই আল্লাহর কাছে পরম মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মিথ্যা কথা বলা কপটতা বা মুনাফেকির নিদর্শনও বটে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুনাফেকির চিহ্ন বা নিদর্শন তিনটি। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে।’ প্রতিশ্রুতি না রাখা বা অঙ্গীকার ভঙ্গ করাও এক প্রকার মিথ্যা। তাই রোজাদার মুসলমানের সর্বাবস্থায় অঙ্গীকার রক্ষা করা উচিত। কোনো কথা শোনার পর তা যাচাই না করে বলতে থাকা মানুষকে একপর্যায়ে মিথ্যা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তাই নবী করিম (সা.) মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শোনে তা-ই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম)
মাহে রমজানে রোজার কাঙ্ক্ষিত ফায়দা হাসিল করতে হলে মিথ্যাচার পরিত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নেক আমলের প্রতিও রোজাদারদের বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। গুরুজনেরা যথার্থই ধর্মের উপদেশ বাণী প্রচার করে থাকেন, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ, মিথ্যা সব পাপের মূল।’ তাই বলা হয়, ‘মিথ্যা সকল পাপের জননী।’ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মিথ্যাবাদিতা এমন গুরুতর পাপ যে রোজাদার যখন একটি মিথ্যা কথা মুখে উচ্চারণ করে, তখন তার কাঁধের ফেরেশতাদ্বয় তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। মিথ্যাচারের ভয়াবহতা সম্বন্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার নাম করে কোনো মিথ্যা কথা বলে সে যেন তার অবস্থান জাহান্নামে অনুসন্ধান করে।’ (মুসলিম)
বর্তমান সমাজে কথায় কথায় মিথ্যাচারিতা, মিথ্যা অপবাদ, কলঙ্ক রটানো, অসাক্ষাতে নিন্দা ও প্রতারণামূলক অন্যায় কার্যকলাপ কমবেশি ঘটছে। সদাচার ও মিথ্যাচার উভয়টিই মানুষের ভেতর তথা মনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলো মানুষের কথাবার্তা, কাজকর্ম, ব্যবহার ও আচার-আচরণে প্রকাশ পায়। তাই ইসলামে প্রকাশ্যে ও গোপনে, কথা ও কাজে সামঞ্জস্য থাকা অপরিহার্য ব্যাপার। ভেতর ও বাইরে সামঞ্জস্যহীন কাজই হচ্ছে মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা ও কপটতা বা মুনাফেকি, যার অনিষ্টকর প্রভাবে মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় জীবন প্রভাবিত হয়।
সুতরাং রমজান মাসে রোজা পালন করে কখনোই মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা ও বাতিল মজলিশে যোগ দেওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া যাবে না। যদি কেউ মিথ্যা ও বাতিল মজলিশের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে, তবে গাম্ভীর্য ও ভদ্রতাসহকারে রোজাদারের তা এড়িয়ে বা পরিহার করে চলে যাওয়া উচিত।হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে যে ‘বহু রোজাদার রোজার মাধ্যমে ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না এবং রাতের বহু নামাজি রাত জাগরণ ছাড়া অন্য কিছুই পায় না।’ (ইবনে মাজা) রমজান মাসে কতক কপট রোজাদারের মিথ্যা কথা বলা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং তদনুযায়ী আমল পরিত্যাগ করতে বা খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, এমন ব্যক্তির পানাহার পরিত্যাগ করার প্রয়োজন আল্লাহর নেই।’ (বুখারি)
পক্ষান্তরে নিখুঁত ও মর্যাদাপূর্ণ রোজা হলো এই যে রোজাদার ব্যক্তি কখনোই মিথ্যা কথা বলবে না, অপকর্ম করবে না, প্রতারণা করবে না, ঘুষ খাবে না, জিনিস বাটে কোনো প্রকার দ্রব্য নেওয়ার সময় বেশি মেপে নেবে না এবং দেওয়ার সময় কম মেপে দেবে না। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার কঠিন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি রোজাদার মুসলমান যদি মিথ্যাচার বর্জনের প্রাত্যহিক অভ্যাস গড়ে তোলেন, তাহলে সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার, পাপাচার বিলুপ্ত হয়ে পৃথিবী শান্তির আবাসস্থলে পরিণত হতে বাধ্য। অতএব, মাহে রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী রোজাদারদের মিথ্যাচারিতা পরিহার করা, কোনো অবস্থায়ই মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া এবং সর্বাবস্থায় সততার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে সত্যাশ্রয়ী হওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।
[email protected]