যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের ভয়াবহ ফল পাচ্ছে আফগানিস্তান

কাবুলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাইরে তালেবান যোদ্ধাদের পাহারা
ছবি: এএফপি

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তাঁর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশ করায় তাঁর সরকারের পতন হয়েছে। ১৯৭৫ সালে সায়গনের কলঙ্কজনক স্মৃতি ফিরে এসেছে। দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর সরব উপস্থিতি মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে নেই হয়ে গেছে। এটা কী করে সম্ভব হলো?

এমন কিছু যুদ্ধ আছে, যেগুলোর জন্ম প্রয়োজনীয়তা থেকেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৯০-৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের কথা বলা যায়। এ ধরনের যুদ্ধে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত করা হয়। কারণ, এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রক্ষার একমাত্র পথ এটাই। আরও কিছু যুদ্ধ আছে, যেগুলো বেছে নেওয়া যুদ্ধ বলা হয়। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধে স্বার্থের জায়গা গুরুত্বের বিবেচনায় কম। এখন আমরা নতুন করে সৈন্য প্রত্যাহারের পথ বেছে নেওয়ার বিষয়টিও দেখছি। যখন একটি সরকার তার সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়, সেটা অস্ত্রোপচারের মঞ্চ খালি করে চলে আসার মতো একটা বিষয়। উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কিংবা সেনাদের উপস্থিতি আর গ্রহণযোগ্য নয় কিংবা সেখানকার সরকার আর তাদের সাদরে গ্রহণ করছে না—এসব কারণে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়নি। বাইডেন প্রশাসনের যাত্রা শুরুর সময় আফগানিস্তানে এমন একটি পরিস্থিতিও যুক্তরাষ্ট্র খুঁজে পাবে না।

আমেরিকান সৈন্যরা আফগানিস্তানে প্রথম যায় ২০ বছর আগে। আফগান গোত্রীয় যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তারা তালেবান সরকারকে উচ্ছেদ শুরু করে। তালেবান সরকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তারা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার জন্য দায়ী ছিল। ওই হামলায় তিন হাজারের মতো মানুষ নিহত হয়েছিল। আফগানিস্তানে অভিযান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তালেবান পালাতে শুরু করে। তাদের অনেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের আবার সংগঠিত করে। আফগান সরকারের বিরুদ্ধে আবার লড়াই শুরু করে।

বছর যত গেছে, সেখানে সৈন্যসংখ্যা তত বাড়ানো হয়েছে। বারাক ওবামার আমলে সেখানে সৈন্যসংখ্যা গিয়ে ঠেকেছিল ১ লাখ ১০ হাজারে। এভাবেই আফগানিস্তানে আমেরিকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়ানো হয়েছে। এ যুদ্ধের ব্যয় ছিল পর্বতস্পর্শী। দুই ট্রিলিয়ন ডলার। জীবন দিতে হয়েছে ২ হাজার ৫০০ আমেরিকানকে। মিত্র জোটের হারাতে হয়েছে ১ হাজার ১০০ জনকে। একই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে আফগান বাহিনীর ৭০ হাজার সদস্য এবং ৫০ হাজার সাধারণ নাগরিক। এর বিনিময়ে ফলাফল ছিল মাঝারি গোছের। সেখানে একটা নির্বাচিত সরকার বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের ক্ষমতার মুঠি ছিল আলগা। আর তালেবান অনেক ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ আবার প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আফগানিস্তানে আমেরিকার হস্তক্ষেপটি ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে বড় করে তোলা একটা ঘটনার ধ্রুপদি উদাহরণ। খুব অল্প সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় এই যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে টেনে বাড়ানো হয়েছে। সেটাকে বেছে নেওয়া হয়েছে ব্যয়বহুল যুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের আমল যখন শুরু হয়েছিল, তখন সেটা অতীতের ঘটনা। সে সময়ে আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যসংখ্যা তিন হাজারে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাদের ভূমিকা তখন আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির পর সেখানে আমেরিকান সেনাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে আফগানিস্তান ইস্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। ২০২০ সালের নির্বাচনে আমেরিকানরা এই দেশকে মাথায় রেখে ভোট দেয়নি, মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় প্রতিবাদেও নামেনি। ২০ বছর পর আমেরিকা সেখানে নিজেদের অংশগ্রহণ কমিয়ে অংশীজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সম্পর্কে এসে পৌঁছেছে। তাদের উপস্থিতি সেখানে সামরিক বিজয় কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠা করত না। কিন্তু তাদের উপস্থিতি একটা সরকারের ধসে যাওয়াটাকে ঠেকাতে পারত। সেই সরকারের যতই দোষত্রুটি থাকুক না কেন, এখন যারা ক্ষমতায় এল, তাদের তুলনায় তারা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বিকল্প। কোনো কোনো সময় বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আপনি কোনটা পূরণ করছেন, তার চেয়ে কোনটা এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আফগানিস্তান সেই ধরনের একটি ঘটনার দৃষ্টান্ত।

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা তড়িঘড়ি ও দুর্বল। আমেরিকা ও আফগান সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে এমন ঝুঁকিতে থাকা লোকদের সরিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় রাখা হয়নি। আফগানিস্তানের এখনকার ঘটনাপ্রবাহ আমেরিকার কৌশলের ভয়াবহ পরিণতি।

কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নয়। বাইডেন প্রশাসন পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের খসড়ার বাস্তবায়ন করেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তালেবানের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি ট্রাম্প প্রশাসন করে। আফগান সরকারকে বাদ দিয়েই এ চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিতে তালেবানকে নিরস্ত্র হওয়া কিংবা গোলাগুলি বন্ধের অঙ্গীকারের কথা বলা নেই। শুধু আফগান ভূখণ্ডে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া হবে না, এ বিষয়ে তারা সম্মত হয়। এটা কোনোভাবেই একটা শান্তি চুক্তি নয়। এটা এমন একটা সন্ধি, যেখানে আমেরিকাকে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের লজ্জা ঢাকার জন্য পাতলা একটুকরা কাপড়ের আচ্ছাদন দেওয়া হয়েছে।

বাইডেন প্রশাসন এই গভীর খুঁতে ভরা চুক্তির সবটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শুধু সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা তিন মাস বাড়িয়েছে। আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল, সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর (বাস্তবে এখন যেটা হচ্ছে) আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে। হতাশাগ্রস্ত সরকারের কাছ থেকে তালেবানের হাতে ক্ষমতার বদল হবে। এখন আফগানিস্তানের পুরো নিয়ন্ত্রণ তালেবানের কাছে যাওয়ার পর সেখানে ব্যাপকভাবে প্রতিহিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়বে। নারী ও শিশুদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসবে। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপ তৈরি হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র।

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা তড়িঘড়ি ও দুর্বল। আমেরিকা ও আফগান সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে এমন ঝুঁকিতে থাকা লোকদের সরিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় রাখা হয়নি। আফগানিস্তানের এখনকার ঘটনাপ্রবাহ আমেরিকার কৌশলের ভয়াবহ পরিণতি। এই নৈতিক ব্যর্থতা আমেরিকার শত্রুমিত্র–সম্পর্কিত বহুল চর্চিত প্রশ্নটিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে।

বাইডেনকে খুব সম্প্রতি জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্তের জন্য তার কোনো অনুশোচনা হচ্ছে কি না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, না, হচ্ছে না। কিন্তু তার অনুশোচনা হওয়া উচিত।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

রিচার্ড এন হান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কাউন্সিলের সভাপতি