রাহুলকে ঘিরে হেঁয়ালি তবু কাটল না

রাহুল গান্ধীছবি : রয়টার্স

কংগ্রেসের প্রথম সারির ২৩ জন নেতার লেখা চিঠির কথা ফাঁস হওয়া এবং ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র দুই দিনের। ওই চিঠি অনেককেই উৎফুল্ল করেছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন, ১৩৪ বছরের ক্ষয়িষ্ণু এ দল এবার হয়তো গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। পরিবারতন্ত্রের কাঠামো না ভাঙলেও হয়তো যৌথ নেতৃত্বের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কিছু একটা করবে। অ্যাডহক রীতির বাইরে বেরিয়ে সাংগঠনিক নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ার পথে হাঁটবে। দল পরিচালনার ক্ষেত্রে সংস্কারের আশ্রয় নেবে।

আশাবাদীদের সেই দলে আমি ছিলাম না। কারণ, অতীতে এমন ধরনের সংকট যতবার এসেছে, দেখেছি, পরিবারপন্থীরা এক জোট হয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে সংস্কারপন্থী অথবা বিদ্রোহীদের দাবিয়ে দিয়েছেন। হাত শক্ত করেছেন গান্ধী পরিবারের। সাহায্য করেছেন স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এবারও যে সেই ধারাবাহিকতাই চালু থাকবে।

সোনিয়া গান্ধীকে চিঠিটা লেখা হয়েছিল ৭ আগস্ট। সেই চিঠি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয় ২২ তারিখ, ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের ঠিক দুই দিন আগে। কে বা কারা চিঠি ফাঁস করেছিলেন, অজানা। যদিও এটা নিশ্চিত, ওই চিঠি হাতে পাওয়ার পরই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কৌশল ঠিক করার জন্য অন্তর্বর্তী দুই সপ্তাহ গান্ধী পরিবারের কাছে ছিল যথেষ্ট। অতীতের মতো এবারও গান্ধী পরিবার ও পরিবারপন্থীরা একজোট হয়ে দুটো কাজ করেন। প্রথম কাজ, পরিবারতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষাকে অপরিহার্য প্রতিপন্ন করা। সে জন্য বিভিন্ন অনুগতকে দিয়ে জোরালো আওয়াজ তোলা। দ্বিতীয় কাজ, যৌথ নেতৃত্ব স্থাপন, গণতন্ত্রীকরণ ও ২৪ ঘণ্টার সভাপতি নির্বাচনের দাবিদারদের ‘বিজেপির এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা। তৃতীয় একটা কাজও তাঁরা এই ফাঁকে করে ফেলতে চেয়েছেন। প্রচার করেছেন, ওই নেতারা গান্ধী পরিবারের ক্ষমতা খর্ব করে কংগ্রেসকে দুর্বল করতে চাইছেন।

অতীতে দেখা গেছে, সংকট নিরসনে গান্ধী পরিবারের তৎকালীন ক্ষমতাসীনেরা পদ ছেড়ে দেওয়ার অভিপ্রায় দেখান। সঙ্গে সঙ্গেই অনুগতরা সমস্বরে তাঁকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। অবশেষে সেই অনুরোধ মেনে একটা সমাধানের সূত্রে পৌঁছানোর জন্য সময় চেয়ে নেওয়া হয়। চেনা চিত্রনাট্য।

এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সোমবার দিনভর যা হলো, অতীতের চিত্রনাট্যের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র অমিল নেই। সোনিয়া গান্ধী সভার শুরুতেই পদত্যাগের কথা জানান। সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানান দুই প্রবীণ নেতা মনমোহন সিং এবং এ কে অ্যান্টনি। সেই কোরাসে গলা মেলান অন্যরাও। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নন, এমন কেউ কেউ পত্রলেখকদের সঙ্গে বিজেপির ‘গোপন আঁতাত’ থাকার অভিযোগ তুললেন। প্রচার করা হলো, স্বয়ং রাহুল গান্ধী নাকি সেই অভিযোগ করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন কপিল সিব্বল ও গুলাম নবী আজাদরা। সিব্বল টুইটও করে ফেললেন বৈঠক চলাকালে। টুইট দেখে রাহুল ফোন করলেন সিব্বলকে। বললেন, এমন কোনো সন্দেহ তিনি প্রকাশই করেননি। আশ্বস্ত সিব্বল টুইট প্রত্যাহার করলেন। আজাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বললেন, গান্ধী পরিবারকে ছোট করার কোনো অভিপ্রায় তাঁদের নেই। পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সঙ্গে যা বললেন, তাতে স্পষ্ট, দলে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে প্রয়োজনীয়তা তাঁরা অনুভব করছেন; সেটাই পরিত্রাণের একমাত্র উপায়।

আপাতত মাস ছয়েকের সময় পেল গান্ধী পরিবার। অতীতেও সংকট নিরসনে এভাবেই সময় নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস রাজনীতির ‘চাণক্য’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ঘনিষ্ঠ মহলে বারবার একটা কথা বলতেন, ‘ঠান্ডা করকে খাও।’ অর্থাৎ সমস্যা থিতোতে দাও। তড়িঘড়ি সমাধানের রাস্তায় হেঁটো না। কংগ্রেসিরাও ওটাই আপ্তবাক্য বলে মনে করেছেন। বিশ্বাস করেছেন, সময় সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ছয় মাস পর পরিস্থিতি কোন দিকে এগোবে, কেউ জানে না। সাংগঠনিক নির্বাচন বা যৌথ নেতৃত্বের দাবির কী হাল হয় দেখে তখন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। লক্ষ্য, গান্ধী পরিবারের ‘ক্ষমতা ও অধিষ্ঠান’ অপরিবর্তিত রেখে দলকে ‘শক্তিশালী’ করা। সেই সুযোগ সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কা পাচ্ছেন। কিন্তু রাহুল কী করবেন—সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর সোমবারের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক থেকে বের হয়নি। রাহুল কী করবেন, তা ধাঁধাই রয়ে গেল।

যে পরিবার কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় সম্পদ, কয়েক বছর ধরে সেটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছেন রাহুলই। তাঁর আচরণে স্পষ্ট নয় বারো মাস বা তিন শ পঁয়ষট্টি দিন তিনি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হবেন কি না। চারপাশে নিজেই ধোঁয়াশার যে বলয় সৃষ্টি করেছেন, কবে তা কাটাবেন, অজানা। দায়িত্ব না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ভাঙবেন কি না, তা–ও জানা নেই। দলে দায়িত্বহীন সর্বেসর্বা হিসেবে থাকলে, অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপও ঝুলে থাকবে। দলও দুর্বল থাকবে। কিন্তু তবু কী যুক্তিতে রাহুল এখনো ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ আচরণ করছেন, কংগ্রেসিদের কাছে সেই হেঁয়ালির উত্তর নেই। পত্রলেখকেরা বলছেন, দ্রুত এ অচলায়তন দূর হওয়া প্রয়োজন। না হলে অতল থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই।

গান্ধী পরিবার এ মুহূর্তে কংগ্রেসের ‘সমস্যা’ হলে ‘সমাধানও’ কিন্তু তারাই। কংগ্রেসিদের জোটবদ্ধ রাখতে এই পরিবারই সক্ষম। আবার এই পরিবারতন্ত্রই কংগ্রেসের বড় বড় আঞ্চলিক নেতাকে নিজস্ব পথে চলতে বাধ্য করেছে। যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি বাস্তবায়িত হলে দলত্যাগী কংগ্রেসিদের ঘরে ফেরার তাগিদ যে অনুভূত হবে না, কে বলতে পারে? নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর বিজেপি ওই আঞ্চলিক নেতাদের জীবনও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। কংগ্রেসের মতো তাঁদেরও বাঁচার একটাই উপায়—ঘরে ফেরা; সংঘবদ্ধ হওয়া।

সেই দায়িত্ব নিতে হলে গান্ধী পরিবারকেই এগোতে হবে। সংকট মোকাবিলার চাবিকাঠি যে তাঁদেরই হাতে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি