সঠিক তথ্য ছাড়াই নীতি–নির্ধারণ হয়?

তথ্যে কোনো গোঁজামিল থাকলে জাতীয় নীতি নির্ধারণেও ভুল হয়
ছবি: প্রথম আলো

২২ আগস্ট প্রথম আলোকে দেওয়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম এক সাক্ষাৎকারে বললেন, বাংলাদেশে আগে প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়, পরে হিসাব মেলানো হয়। দেশে শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, আরও অনেক তথ্য-উপাত্ত আগে থেকে নির্ধারণ করা হয়, পরে শুধু হিসাব মেলানো হয়।

বিষয়টি আমি বা যাঁরা বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করেছেন, তাঁদের কাছে মোটেও নতুন নয়।

২০১৯ সালের মে মাসে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং জানিয়েছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। দেশের পত্রপত্রিকায়ও এই নিয়ে অতীতে অনেক লেখালেখি হয়েছে।

আমার পিএইচডিকালীন অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে আসতেন। আমার ব্যবহার করা বাংলাদেশের কিছু কিছু তথ্যে অসংগতি থাকায় সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করে জেনেছি, আমাদের অনেক তথ্য-উপাত্ত অফিসে বসে তৈরি করা হয়, সংগ্রহ করা হয় না। এর জন্য কি আমাদের দুর্বল প্রচলিত প্রথা ও সংস্কৃতিই দায়ী? নাকি ডেটা সংগ্রহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা দায়ী? নাকি সরকারের দুর্বলতা দায়ী, জানি না। তবে সরকারকে অবশ্যই এতে শক্ত ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করি। কারণ, এটি দেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত।

প্রতিটি দেশই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করে। এই তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহে প্রচুর ব্যয় হয় বলে সাধারণত এটি সরকারকেই করতে হয় আর সরকার এর দায়ভার একটি প্রশিক্ষিত সংস্থার ওপর ন্যস্ত করে। সব দেশেই সাধারণত একটি ‘পরিসংখ্যান বিভাগ’ থাকে, যা দেশের জাতীয় আয়, জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি, বেকারত্বের হার, আমদানি-রপ্তানির হিসাবে রাজস্ব আয়, সরকারি ব্যয়, মূল্যস্ফীতির হার, বিদেশি বিনিয়োগ, মুদ্রার বিনিময় হার, সুদের হার, অর্থের জোগান ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্যগুলো দেশের পরবর্তী বার্ষিক, দ্বিবার্ষিক বা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করে। আবার এই তথ্য ব্যবহার করে অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকেরা সরকারকে ভবিষ্যতের নীতি প্রণয়নে সহযোগিতা করে থাকেন। কিন্তু এই তথ্যে কোনো গোঁজামিল থাকলে তা ব্যবহার করে করা জাতীয় নীতি নির্ধারণেও ভুল হয়। আর ভুল নীতিনির্ধারণ দেশের অর্থনীতিকে ভুল পথে পরিচালনা করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশের জন্য উল্লেখিত তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আরও অনেকেই বিবিএস থেকে এই ডেটা সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু অনেকেই বাংলাদেশের ডেটা বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বের হার নির্ণয়ের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এ তো গেল ডেটার অনির্ভরযোগ্যতার কথা। অন্যদিকে বিবিএস দেশের অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, সংকলন এবং সংরক্ষণও করে না। অনেক ক্ষেত্রে বিবিএসের কাছে দায়সারা গোছের কিছু ডেটা থাকলেও ডেটা সংগ্রহে এবং সংকলনে পেশাদারত্বের অভাবে সেই ডেটা ব্যবহারের উপযোগী থাকে না।

একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার পিএইচডি গবেষণায় বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি মূল্যসূচক ব্যবহার করছিলাম। এই উপাত্ত তখন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলে আমার ব্রিটিশ সুপারভাইজার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে এর প্রাপ্যতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে বিবিএস থেকে আমরা ডেটা কিনে নেব। এখানে বলে রাখা ভালো, আমার এই সুপারভাইজার ব্রিটিশ ‘অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস’ এবং ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ থেকে অনেক সময় অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন অনলাইন। তাই তিনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে বিবিএসকে ই–মেইলটি করেছিলেন। কিন্তু ওই ই–মেইলের জবাব তিনি কোনো দিনই পাননি। সুপারভাইজার তখন আমাকে বাংলাদেশের ওপর গবেষণা বাদ দিয়ে যুক্তরাজ্যের ওপর একই বিষয়ে গবেষণার প্রস্তাব করেছিলেন।

বাংলাদেশের কিছু কিছু তথ্যে অসংগতি থাকার কারণ কি আমাদের দুর্বল প্রচলিত প্রথা ও সংস্কৃতি?
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন হলো, তবে কি বিবিএসের কাছে আসলে সেই তথ্য ছিল না? না! সেই তথ্য তাদের কাছে ছিল। পরে আমি দেশে গিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে বিবিএসের লাইব্রেরিতে গিয়ে সেই তথ্য জোগাড় করেছি। অথচ বিবিএস চাইলে এই ডেটা আমাদের কাছে বিক্রি করতে পারত।

শত শত বাংলাদেশি স্কলার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইউরোপের অন্যান্য দেশ, হংকং, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশে অবস্থান করছেন। এই বাংলাদেশি স্কলারদের অনেকেই বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করছেন। আবার অনেকে প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্তের অভাবে বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করতে চেয়েও পারছেন না। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে শত শত পিএইচডি গবেষক বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। এঁদের অনেকেই বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করার মানসিকতা নিয়েই বিদেশে পড়তে যান। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্তের অভাবে তাঁদের গবেষণার বিষয় পরিবর্তন করতে হয়। অথচ বাংলাদেশ যদি এই তথ্য–উপাত্ত ঠিকমতো সংগ্রহ ও প্রকাশ করে, তবে হাজার হাজার বাংলাদেশি এবং অনেক বিদেশিও বিনা খরচে বাংলাদেশকে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা উপহার দেবেন; যা বাংলাদেশের পলিসি নির্ধারণে অত্যন্ত সহায়ক হবে। সংগৃহীত এই তথ্য–উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশ শুধু তার ভবিষ্যৎ নীতি প্রণয়নই নয়, দেশ এই তথ্য–উপাত্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ডেটা সংগ্রহকারী সংস্থার কাছে বিক্রিও করতে পারবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে। এই তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে পেশাদারত্ব আনা গেলে এগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে। এর জন্য দরকার সরকারের বিশেষ উদ্যোগ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ জিডিপির শূন্য দশমিক ১ শতাংশের কম ‘গবেষণা ও বিকাশ’ খাতে ব্যয় করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, এমনকি মিয়ানমারও এই খাতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি খরচ করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ইউনেসকো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিকস গবেষণা ও বিকাশ খাতে কোন দেশ জিডিপির কত অংশ ব্যয় করে, তার ভিত্তিতে ১৪১টি দেশের তালিকা করেছে। সেখানে বাংলাদেশের কোনো স্থান হয়নি। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, গবেষণা ও বিকাশ খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করে আমেরিকা, এরপরই যথাক্রমে চীন, জাপান, জার্মানি ও ভারতের স্থান।

বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা জার্নালের প্রবন্ধের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৪ থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর গড়ে প্রতিবছর ১৪ শতাংশের বেশি গবেষণা প্রবন্ধের প্রকাশ বেড়েছে। দেশের জন্য এটি খুবই ভালো লক্ষণ। নিম্নোক্ত কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। প্রথমত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও অনেক গবেষক নিজ উদ্যোগে বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক ‘গবেষণা অনুদান’ সংগ্রহ করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, আমাদের কিছু বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ সংগ্রহ করে দেশের ওপর গবেষণা করছেন। তৃতীয়ত, অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি তাদের নিজস্ব অর্থয়নে বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করছে। চতুর্থত, বিশেষ করে, বাংলাদেশের অনেক স্কলার বিদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশের ওপর গবেষণা করছেন। পঞ্চমত, দেশের অনেক গবেষক বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, যারা সময় বের করে দেশের ওপর গবেষণা করছেন। ষষ্ঠত, আমাদের অনেক পিএইচডি গবেষক বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বসে বাংলাদেশের ওপর গবেষণা করছেন।

এই ধারা অব্যাহত রাখতে এবং দেশের উন্নয়ন-নীতি-নির্ধারণে সহায়ক গবেষণাকে অনুপ্রাণিত করতে জিডিপির অন্তত ১ শতাংশ গবেষণা বরাদ্দে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে আরও পেশাদারত্ব আনা দরকার। বিবিএস, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং তো দূরের কথা, এশিয়ান র‍্যাঙ্কিং কোনো স্থান পাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়লে দেশে যেমন নতুন নতুন আবিষ্কার হবে, তেমনি উদ্ভাবনী ও বাস্তবসম্মত গবেষণা দেশের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হবে।

নুসরাতে আজিজ: অধ্যাপক, আলগমা ইউনিভার্সিটি, কানাডা।