সম্প্রীতির মালা গাঁথি ভেদাভেদ নাশে

মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে আসছে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন কোভিড মহামারি-পরবর্তী পৃথিবী আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মানুষের এই চেষ্টার সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধ। বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও। কোভিড মহামারির কারণে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনটিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু পরে। কিন্তু মহামারির ওই কঠিন সময়েও বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল মৌলবাদীদের আস্ফালন আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। গত বছর শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালে বীভৎস সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের চিত্র আমাদের দেখতে হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে কীভাবে সারা দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া হলো, কীভাবে নির্যাতন করা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের, সেসব ভয়াবহ ঘটনা এই কোভিড মহামারির মধ্যেই আমাদের দেখতে হয়েছে। কোভিড ভাইরাসটি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলেও মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার ভয়াল ভাইরাসটি মোকাবিলার কোনো কার্যকর প্রতিষেধক আমরা আজও তৈরি করতে পারিনি। এখনো মুক্তচিন্তা আর বাক্‌স্বাধীনতার পথের বাধাগুলো দূর হয়নি, উল্টো নানা আইনকানুনের নামে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থেকে মানুষের মুক্তচিন্তার অধিকারও হরণ করা হচ্ছে।

মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৬৮-৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী যেমন অংশ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে উদীচী প্রতিবাদের মিছিলে হেঁটেছে আদর্শের মশাল হাতে।

বর্তমান রাজনীতিতে গুজব এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, কিন্তু তা প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। ধর্মান্ধতার ভাইরাস যে কতখানি আক্রান্ত করেছে এ রাষ্ট্রকে, তার নজির আমরা পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। শিক্ষক লতা সমাদ্দারের ওপর পুলিশের সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের অন্যায় কারাবাস বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিনা দোষে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে বন্দী থাকা রসরাজ, ঝুমন দাসসহ অনেকের অবস্থাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একটি জোর সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আর সেই প্রত্যয় থেকেই আজ থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী উদীচীর জাতীয় সম্মেলনের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে—‘শ্রেণিভেদ ভাঙি শোষিতের রোষে/ সম্প্রীতির মালা গাঁথি ভেদাভেদ নাশে’।

মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করে আসছে। ১৯৬৮-৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে উদীচী যেমন অংশ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে উদীচী প্রতিবাদের মিছিলে হেঁটেছে আদর্শের মশাল হাতে। সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ছড়িয়ে দিতে উদীচীর প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা সংসদ ও জেলা সংসদের অধীন থাকা প্রতিটি শাখা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বাইরেও উদীচীর শাখা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়। বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সারসহ একঝাঁক তরুণ ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উদীচী।

প্রতিষ্ঠাকালীন প্রতিটি মানুষের আদর্শ, ত্যাগ আর সংগ্রামের ইতিহাস উদীচীর কর্মী হিসেবে আমাদের প্রতিদিনের পাঠ্য। সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথচলায় মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে জীবনের গান গেয়ে দ্রোহের বীণায় উদীচী শুনিয়েছে অসুরবিনাশী সুর। আজ যখন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উদীচীর ২২তম জাতীয় সম্মেলন, তখন কবি বিপুল চক্রবর্তীর কবিতায় সুর দেওয়া উদীচীর গানেই যেন স্মরণ করতে হয় আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে—‘তোমার স্বদেশ লুট হয়ে যায় প্রতিদিন প্রতিরাতে/ বিরুদ্ধতার চাবুক উঠাও হাতে।’

আজ যখন মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে কারারুদ্ধ করে সোনার বাংলায় নেমে আসে সাম্প্রদায়িক হায়েনাদের বিষাক্ত পদচ্ছাপ, যখন ঘরে-বাইরে নারীর ওপর চলে নির্মম নির্যাতন; তখন জনতার ঐক্যই হয়ে উঠতে পারে মূল শক্তি। আর সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

কিন্তু একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে এ কথাও আমি স্বীকার করতে প্রস্তুত, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা, অনাবাদে তা আজ বেহাত হতে চলেছে। প্রতিমুহূর্তে আমাদের সাংস্কৃতিক নানা উৎসবের ওপর নেমে আসছে সাম্প্রদায়িক ফতোয়া। রাষ্ট্র যেন কখনো কখনো তা দেখেও দেখছে না। আজ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। অথচ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সেই দিনগুলোয় রাজনীতি ও সংস্কৃতি হাতে হাত রেখে পথ চলেছে। এই সংস্কৃতিবিবর্জিত রাজনীতি তাই হয়ে উঠেছে কতগুলো দানবের পিঠ বাঁচানোর পথ আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবিহীন সংস্কৃতি কেবল পরিবেশনায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকছে। এর সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী রাজনীতি থেকে শুরু করে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিটি পক্ষ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির যেমন সমন্বয় প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বলয়ের বৃহৎ সংজ্ঞায়ন। আজ সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলতে আমরা কেবল বাঙালি সংস্কৃতিকেই বুঝে থাকি। কিন্তু পাহাড়ে ও সমতলে আমাদের যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাগরিক রয়েছেন, তাঁদের সংস্কৃতির বিপুল ঐশ্বর্যের সঙ্গে আমাদের কোনো সংযোগ বা সমন্বয় নেই। এ কারণে আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্য তো কেবল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ানোই নয়; যে বিপুল প্রাণ-প্রকৃতির মধ্যে আমরা বেঁচে আছি, তা রক্ষাও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ বলেই মনে করে উদীচী। ফলে বাঙালি-ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ—সবার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বৃহৎ অর্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে। কেবল কিছু উৎসবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনাতে সীমাবদ্ধ থাকলেই পরিস্থিতির বদল ঘটবে না, এর জন্য প্রয়োজন সংস্কৃতির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। আর সে লক্ষ্যে কাজ করে চলছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

উদীচীর ২২তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন হবে আজ সোমবার বেলা তিনটায় ঢাকার মহানগর নাট্যমঞ্চে। উদীচীর এবারের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। উদীচী বিশ্বাস করে, যে মৌল চেতনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার প্রধান স্তম্ভই হলো অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কার্যত সে লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের হয়েছে সত্যি, কিন্তু তার সঙ্গে বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এ সামঞ্জস্যহীন উন্নয়নে আদতে মুখ থুবড়ে পড়ছে মানুষের মূল্যবোধ, রাজনীতি হয়ে পড়ছে আদর্শহীন আর সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে তার প্রকৃত অর্থ। সত্যেন-রণেশের আঁকা পদচিহ্ন ধরেই সংস্কৃতির সেই গণমুখী অর্থের কাছে ফিরে যেতে হবে। এ উপলব্ধিটুকুই উদীচীর ২২তম জাতীয় সম্মেলনের মূল প্রেরণা। জয় উদীচী।

  • সঙ্গীতা ইমাম উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক