স্কুল না হয় খুলে দিলেন, কিন্তু...

পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা কেবলই হাসিখুশি বালক-বালিকার স্কুল ড্রেস পরা ছবি দেখছি। বেজার মুখ, মন খারাপ, স্কুলে যেতেই চাইছে না, স্কুল খোলায় আতঙ্কিত—এ রকম বালক-বালিকার ছবি কেউ দেখাচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় যেমন নেই, সামাজিক মাধ্যমেও শেষোক্তদের বিষয়ে তেমন কোনো আলাপচারিতা নেই।

স্কুল খুলেছে—খবরটি নিশ্চয়ই আনন্দের। সে জন্য সব মহলে যে আলাপ-আলোচনা ও উৎসাহ-উচ্ছ্বাস, সেটি বোধগম্য। তবু আমলে নিতে হয়, সব সত্যেরই কিন্তু দুটি পিঠ থাকে ও আছে। স্কুল খোলায় বালক-বালিকারা আনন্দিত—এক পিঠ সত্য। স্কুল খোলায় একদল বালক-বালিকার হাসি-আনন্দ কর্পূরের মতো উবে গেছে—আরেক পিঠ সত্য। বছর দেড়েকের স্কুল বন্ধে বালক-বালিকাদের শেষোক্ত অংশটি স্কুলবিহীন জগতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে স্কুল খোলার ঘোষণায় তাদের অনেকেই বিমর্ষ, বিষণ্ন ও মনোযাতনাক্লিষ্ট। অনেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য ভঙ্গুর। অনেকের মধ্যেই ভীতি ও আত্মবিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। কোভিডকালে অনিয়মে স্কুলবহির্ভূত নানা কর্মকাণ্ড ও গেম-গেজেটে আসক্তি বেড়েছে অনেক কিশোর-কিশোরীর। এসব বাস্তবতাও তাদের স্কুলে ফেরায় অনাগ্রহের কারণ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাদের বিষয়েও কি ভাবতে হবে? পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের ছবিছাবা বা মনোভাবের ফিরিস্তি দিতে হবে? সেসব কি আদৌ দরকারি?
সব কটি প্রশ্নেরই উত্তর—‘হ্যাঁ, অবশ্যই’। তাদের বিষয়ে কেন ভাবতে হবে? ভাবতে হবে, কারণ হাসিখুশি বালক-বালিকাদের অভিযোজন সমস্যা নেই। তারা পাঠ-প্রস্তুত।

বিদ্যালয়-প্রস্তুত। মানসিকভাবে তারা অভিযোজিত হয়েই আছে। সমস্যা দ্বিতীয় দলকে নিয়ে। তাদের অনভ্যস্ত হয়ে পড়া একটি সমস্যা। তাদের পূর্ণকালীন ছাত্রত্বে আবার ফিরিয়ে আনার বেলায় অন্তর্বর্তীকালীন নিয়মভঙ্গের অভিজ্ঞতা বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের আত্মবিশ্বাস হারানোও সমান সমস্যাজনক।
অথচ শিক্ষার্থীদের এই নাজুক অংশের সমস্যাগুলোই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত মনে হচ্ছে।

পরীক্ষাব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের পাঠ-প্রস্তুতিতে এবং জানা ও শেখায় ব্যস্ত রাখে। উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজনে নেওয়া পাঠ-প্রস্তুতির সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক ফল থাকে।

ছাত্রছাত্রীদের অভ্যস্ততায় ভাটা পড়েনি। ফলে আত্মবিশ্বাসেরও কমতি হয় না। সে বিবেচনায় ‘অটো পাস’ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের অভ্যস্ততা ও আত্মবিশ্বাস—দুটিতেই ঘাটতি থাকবে। এ অবস্থায় তাদের ফের বিদ্যায়তনে ফেরার আত্মবিশ্বাস কতটুকু আছে, তা জানার জন্য কোনো জরিপ কি হয়েছে? তারা আসলে শিক্ষায় কতটুকু পিছিয়ে পড়েছে, এ রকম কোনো মান নির্ণয় বা পর্যায় নির্ধারণের ব্যবস্থা কি হয়েছে? যারা বিনা পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, তারা কি আদৌ এ দুই পর্যায়ের চিরাচরিত মান ধরে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মজীবনে স্বাভাবিক ও কাম্য সক্ষমতা দেখাতে পারবে? কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাদের অতিরিক্ত কোনো মান-সমন্বয়ক বা মান-সমরূপীকারক (ইকুইভ্যালেন্স) পাঠ বা কোর্সের প্রয়োজন হবে কি? হলে সেসবের কোনো প্রস্তুতি রয়েছে কি?

বাংলাদেশের গ্রাম-সমাজের প্রেক্ষাপটে আরেকটি আশঙ্কাও অমূলক নয়—একদল ছাত্রছাত্রী স্বেচ্ছায় ছাত্রত্ব ছেড়ে দিতে পারে। এ রকম ভলান্টারি ড্রপ-আউট বা ইচ্ছাকৃত ঝরে পড়ার কারণ বিনা চেষ্টায় উচ্চমাধ্যমিকের সনদ মিলে যাওয়া। বিশেষত, অসচ্ছল পরিবারের সব বালিকার অভিভাবকদের মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে উচ্চমাধ্যমিক সনদ মিলে যাওয়ার পর বিয়ে-থা, সংসার, সন্তানসন্ততির বিষয়কেই প্রাধান্য দেওয়া দরকার। যেহেতু আরেকবার ‘অটো পাস’-এর ব্যবস্থা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, পুনরায় ছাত্রত্ব গ্রহণ তাদের অনেকের কাছেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে।

বিদ্যালয় খুলে দিলেই রাষ্ট্র ও শিক্ষা প্রশাসনের দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এখনো স্পষ্ট নয় রাষ্ট্র বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘ছাত্রছাত্রীদের মূলধারাকরণ’ ও ‘মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা’ দেওয়ার আদৌ কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কি না।

অটো পাস-সম্পর্কিত স্টিগমাও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইংরেজি ‘স্টিগমা’ শব্দের সহজবোধ্য বাংলা হতে পারে ‘অপবাদমূলক হেয়করণ’। যেমন ‘অটো পাস’ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের এবং সমাজের আমজনতার একধরনের ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হতে পারে। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে হেয় দৃষ্টিতে দেখা হতে পারে। শিক্ষায়তনে বৈষম্য হতে পারে। সেই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কর্মক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে অটো পাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সে বছরের সনদধারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে পরবর্তী দু-তিনটি দশক সাধারণ্যে সন্দেহ ও বিদ্রূপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি টিকে ছিল।

বিদ্যালয় খুলে দিলেই রাষ্ট্র ও শিক্ষা প্রশাসনের দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এখনো স্পষ্ট নয় রাষ্ট্র বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘ছাত্রছাত্রীদের মূলধারাকরণ’ ও ‘মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা’ দেওয়ার আদৌ কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কি না। শিক্ষার্থীদের একাংশকে শ্রেণিকক্ষে পুনঃ অভ্যস্তকরণ একান্তই প্রয়োজনীয় বিষয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্দেশনাও গিয়ে থাকতে পারে। তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিষয়গুলো প্রকাশ্য হওয়া প্রয়োজন।

দুই.
বাংলাদেশ ভিনদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য বিখ্যাত। পুকুর খনন বা খিচুড়ি রান্না শেখার জন্যও বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার খবর আমরা পত্রপত্রিকায় হরহামেশাই দেখি। কিছু বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমরাও ভিনদেশের উদাহরণ টানি। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও সম্ভবত বিভিন্ন দেশের করোনাকালের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করে নিজেদের জন্য সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে রেখেছে।

ইউনিসেফ সপ্তাহ দুই আগে শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বজুড়ে ১৪ কোটি শিশুর বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম দিনের অভিষেক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দিনটির জন্য তাদের এক বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো। বাংলাদেশেও বিদ্যালয়ে প্রথম পা রাখতে চলা শিশুদের বয়স বেড়েছে প্রায় দেড় বছর। ইউনিসেফ এ বছরেরই মার্চের প্রথম সপ্তাহের প্রতিবেদনে জানায়, সারা বিশ্বে প্রাথমিক পর্যায়েই ১৭ কোটি শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম পিছিয়েছে পুরো একটি বছর। উল্লেখ্য, ভুক্তভোগী শিশুদের বড় অংশই তৃতীয় বিশ্বের বা উন্নয়নশীল বিশ্বের। উন্নত বিশ্ব সেভাবে পিছিয়ে থাকেনি।

সারা বিশ্বেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে বয়সের সামঞ্জস্য রক্ষা অঙ্গাঙ্গি প্রয়োজন। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয় সে কারণে গ্রীষ্মকালীন বন্ধ ছাড়া অন্য সময়ে স্কুলগুলো আংশিক ও সাময়িক খোলা-বন্ধের দোলাচলে থাকলেও পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। অনলাইনে এবং সীমিত ব্যবস্থাপনায় সপ্তাহে এক বা দুদিন বিভিন্ন শ্রেণির জন্য পালাক্রমে অফলাইনেও বেশির ভাগ স্কুল চালু ছিল। ফলে, শিশুদের বয়স ও পাঠক্রমের কারণে পিছিয়ে পড়তে হয়নি। জাতিসংঘ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকও সম্প্রতি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া ও পরিত্রাণের উপায় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বিশ্বব্যাংক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল ১৪০টি দেশে পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে জানাচ্ছে, প্রতি তিনটি দেশের মধ্যে একটি দেশ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশের উল্লেখ না থাকায় স্পষ্ট নয় বাংলাদেশ পরিকল্পনাকারী দেশের তালিকাভুক্ত কি না। সম্ভবত তালিকাভুক্ত নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদন দেখিয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকার দিবসসংখ্যায় বাংলাদেশ এশিয়ায় অন্যতম প্রথম সারির দেশ।

স্কুল খুলেছে বলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ নেই। ৫৪৪ দিনের বন্ধ ছাত্রত্ব ও ছাত্র-মানসে ব্যাপক ওলট-পালট ঘটিয়েছে। স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পাঠক্রমের মূলধারাকরণ, ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা সুসংহতকরণসহ ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া এখনই প্রয়োজন।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের সদস্য। [email protected]