স্বাস্থ্য খাতের জন্য পাঁচ সুপারিশ

আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের উন্নতি একটি প্যারাডক্স বা বৈপরীত্যের জন্ম দিয়েছিল। দারিদ্র্য, আয়ের অসমতা এবং সুশাসনের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক ক্ষেত্রে দেশ যেভাবে এগিয়েছে, তাকে অনেক বিজ্ঞজন একটি ‘প্যারাডক্স’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। উন্নয়নের এই দৌড়ে আমরা আমাদের অনেক প্রতিবেশীকে পেছনে ফেলে এসেছি। গেল প্রায় বছর দেড়েক থেকে আমরা কোভিড-১৯ মোকাবিলা করছি। এই যুদ্ধে অনেক শক্তিধর জাতিও ধরাশায়ী হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ দেশ ছিল অপ্রস্তুত, যার মধ্যে আছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ। প্রথম ঢেউ সামলাতে না সামলাতে আমরা প্রায় দুই মাস ধরে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আছি।

অতিমারির নিয়মই হলো এটা ঢেউয়ের মতো আসে, একটার পর আরেকটা। রোগবিজ্ঞানী বা এপিডেমিওলজিস্টরা বলেন যে এই ঢেউয়ের ব্যাপারটা যে সমাজ যত ভালোভাবে বুঝে, সে ততটা সার্থকভাবে তা মোকাবিলা করতে পারে। প্রথম ঢেউয়ের ব্যাপারটা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। অনেক কিছুই করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু খুব কমই সুষ্ঠু এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন। লকডাউনের নামে যা হচ্ছে তাকে তো আর লকডাউন বলা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে, যদিও সরকারি হিসাবমতো আমরা এখনো কঠোর লকডাউনেই আছি।

সৌভাগ্যক্রমে কোভিড পরিস্থিতি এখনো আমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়নি। ভারত বা অন্য কয়েকটি প্রতিবেশীর তুলনায় আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে। কোটি টাকার প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয়েছে? কেন কোভিডের করাল গ্রাস থেকে তুলনামূলকভাবে আমরা এখনো অনেকটা মুক্ত? এর কোনো সঠিক উত্তর জানা নেই।

কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাবে কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র।

দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর প্রথম দিকেই ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া একটা সাহসী পদক্ষেপ ছিল। ঈদের ছুটির প্রাক্কালে রেল ও দূরপাল্লার বাস-লঞ্চ বন্ধ করায় সংক্রমণের দ্রুত বিস্তার কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হয়েছিল। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের জনগণের টিকে থাকার ক্ষমতা। মানুষ চিকিৎসকদের পরামর্শে কান দিয়েছে। অপ্রয়োজনে যাঁরা বাইরে যেতে চাইছেন না, তাঁদের জন্য রয়েছে অনলাইন সেবা। তৃতীয় ঢেউ আসার আগে সরকার এবং সাধারণ মানুষকে আরও প্রস্তুতি নিতে হবে।

বলা হয়ে থাকে, প্রতি সংকটেরই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো ধ্বংসাবশেষের ওপরই তৈরি করল তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিখরচায় উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হলো।

নব্বইয়ের দশকে এক নৃশংস গণহত্যার পর নির্মিত হলো রুয়ান্ডার স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ। আমার মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে কোভিড একটি মহাসুযোগ এনে দিয়েছে। এই লক্ষ্যে আমাদের কী করতে হবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞজনেরা প্রায় সবাই একমত। এগুলোর মধ্যে আমি এ খাতের জন্য পাঁচটি সুপারিশের কথা উল্লেখ করতে চাই। এক, একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠন, যার কাজ হবে দেশব্যাপী কীভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা যায়, তার রূপরেখা তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে নজরদারি করা; দুই, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে একটি ন্যাশনাল হেলথ সিকিউরিটি অফিস স্থাপন, যার কাজ থাকবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ‘পারচেজার রোল’ এবং ‘প্রভাইডার রোল’কে আলাদা করা; তিন, সুশাসন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; চার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা পিএইচসির অগ্রাধিকার বাড়ানো, যার মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ বর্তমানের ২৫ ভাগ থেকে বেড়ে পর্যায়ক্রমে ৫০ ভাগে নিয়ে যাওয়া; পাঁচ, গবেষণায় উপযুক্ত বিনিয়োগ করা এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।