হিংসার ছক, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দেশ

মানুষের হাহাকার আর নেওয়া যাচ্ছে না। হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকেই যেন আক্রমণ করা হচ্ছে।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে প্রদীপ চন্দ্র রায়ের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উপার্জনের একমাত্র সম্বল হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গতকাল রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড়করিমপুর এলাকায়ছবি: মঈনুল ইসলাম

এই গল্পের কি শেষ নেই? উপমহাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বেশির ভাগ ঘটনারই শুরু হয় উড়ো খবর বা গুজবে। ডিজিটাল যুগে উড়ো খবরের বাহন হয়েছে ফেসবুক। এবারের শুরুটাও ফেসবুক থেকে।

১৩ অক্টোবর ফেসবুকে ছড়িয়ে গেল যে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে হনুমানের প্রতিমার কোলে পবিত্র কোরআন পাওয়া গেছে। কে এই কাজ করেছে, তা জানা যায়নি। কিন্তু সেই যে উত্তাপ ছড়াল, তা প্রতিমা ভাঙচুর এবং হিন্দুদের বাড়ি ও দোকানে হামলার ইন্ধন দিল আরও ১০টি জেলায়। সেই উত্তাপই আগুন হয়ে পুড়িয়ে দিল রংপুরের পীরগঞ্জের একটি দরিদ্র জেলেপল্লি। ইতিমধ্যে এসব হামলা ও সংঘাতের ঘটনায় প্রাণ গেছে ছয়জনের।

শুধু মানবিকতাই অবশ হয়ে গেল না, অনেকের যুক্তিবোধও যেন লোপ পেল। কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপের কমিটি বলেছে, মূর্তিটি পূজার জন্য নয়, প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিল। যেহেতু উপমহাদেশে ধর্মীয় গ্রন্থ, মহাপুরুষ কিংবা ধর্মীয় প্রতীক অবমাননা স্পর্শকাতর বিষয়, কুমিল্লার ঘটনার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী উভয় সম্প্রদায়কেই চটাতে চেয়েছে।

একের দায় সম্প্রদায়ের সর্বজন কেন নেবে?

তর্কের খাতিরে বলা যায়, যদি কোনো হিন্দুর কাজও এটা হয়, তাহলে তা কেবলই এক বা কয়েকজনের কাজ। একজনের দায়ে একটি সম্প্রদায়ের সর্বজনকে দায়ী করা যায় না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ বিদ্বেষ এতই সংক্রামক যে অনেকেই তটস্থ হয়ে পড়েন। ধার্মিকের সম্পর্ক বিশ্বাসের সঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক অপরকে অবিশ্বাস করার সঙ্গে। ধর্ম পারলৌকিক, সাম্প্রদায়িকতা ইহজাগতিক স্বার্থের বিষয়। তাই ধার্মিক মাত্রই সাম্প্রদায়িক হন না। সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি আপন ধর্মীয় চর্চায় ততটা নিষ্ঠাবান না হলেও অপর ধর্মের মানুষদের ঘৃণার বেলায় অত্যন্ত তৎপর। এটা যখন স্বার্থসিদ্ধির পথ হয়, তখন ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে।

ছকে কষা হামলা, প্রশাসনের ব্যর্থতা

কুমিল্লার ঘটনার পরের চতুর্থ দিনে গত রোববার রাতে ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা। রংপুরের পীরগঞ্জের দরিদ্র হিন্দুপল্লি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। অর্থাৎ ঘটনার বিবর্তন ছোট থেকে আরও বড় ও বাজে দিকে গেল। দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণাকাজ রয়েছে ভারতীয় অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞানী আশীষ নন্দীর। ভারতের প্রেক্ষাপটে তিনি এক সাক্ষাৎকারে লিখেছিলেন, ‘প্রশাসন চাইলে তিন থেকে ছয় ঘণ্টার বেশি কোনো দাঙ্গা চলতে পারে না। যদি পারে, তাহলে বুঝতে হবে সরকার চেয়েছে বলেই হয়েছে।’ তাঁর ক্রিয়েটিং ন্যাশনালিটি (১৯৯৫, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) বইয়ে এর বিস্তর প্রমাণ রয়েছে।

আজ যখন সর্বস্ব হারানো, নির্যাতিত ও অপমানিত মানুষের আহাজারি শোনা যাচ্ছে, তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন, প্রশাসন কোথায় গেল? সবখানেই ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে যাওয়ার পরে পুলিশ এসেছে। কুমিল্লা ও চাঁদপুরের হিন্দু নেতারা বলেছেন, তাঁরা বারবার ফোন করেও পুলিশের সাড়া পাননি।

পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হামলাযজ্ঞ চলতে পারে না

বাংলাদেশে দাঙ্গা–হাঙ্গামা বেশিক্ষণ চলতে পারে না। দাঙ্গা হয় না, যা হয় তা একচেটিয়া সন্ত্রাস। আক্রমণ হয় কালবৈশাখীর কায়দায়। দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যেই উত্তেজিত লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। কক্সবাজারের রামু থেকে পাবনার সাঁথিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থেকে সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনা লাগাতারভাবে ঘটতে পারেনি। প্রশাসন চায় না বলেই এগুলো দীর্ঘ সময় চলতে পারে না, তা নয়। জনগণও চায় না। এ জন্যই সুযোগসন্ধানীরা হাতে বেশি সময় পায় না। এ জন্যই দেখা যায়, মিছিলে হাজার লোক এলেও সরাসরি হামলায় জড়িত হয় মাত্র কয়েক ডজন। তবে এই প্রথম তারা বেশি সময় পেল। চার দিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর লাগাতার হামলা হলো। প্রশ্ন জাগে, দীর্ঘ পরিকল্পনা, দেশব্যাপী লোকবল, অর্থবল এবং প্রশাসনকে সুবিধামতো ব্যবহার করা ছাড়া এমন ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব, যদি না কাজটির পেছনে সংগঠিত বড় শক্তি থাকে। এই ক্ষমতা কার আছে?

মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বাইরেও রয়েছে র‌্যাব, এপিবিএনের মতো কয়েকটি এলিট ফোর্স এবং আনসার বাহিনীর মতো তৃণমূল প্রহরী। রয়েছে সুদক্ষ কয়েকটি গোয়েন্দা বাহিনী। বাহিনীগুলো অতীতের চেয়ে অনেক বেশি প্রশিক্ষিত। জেলা প্রশাসন এখন অনেক শক্তিশালী। ডিজিটাল প্রযুক্তির বরাতে নজরদারি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার এই বাহিনীগুলোকে দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় বিরোধীদের দুরমুশ করে দিয়েছে। কৌশলীভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০১৩ সালে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ছত্রভঙ্গ করে দিতে পেরেছে। বিরোধীদের চার-পাঁচজনের ঘরোয়া বৈঠকের খবরও তাঁদের অজানা থাকে না। যেখানে নিয়মিতভাবে তাঁদের নেতাদের ফোনের আলাপ ফাঁস হয়, সেখানে এই ধ্বংসযজ্ঞ কেন থামানো গেল না, সেই প্রশ্নও থেকে যায়।

নিষ্ফল নিরাপত্তা, দিশাহীন বক্তব্য, বিতর্কের জন্ম

‘এবারের পূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হতে পারে—এটা আগে থেকে আঁচ করতে না পারার বিষয়টি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না’ (প্রথম আলো, ১৭ অক্টোবর ২০২১)। সাম্প্রদায়িক হামলার কার্যকারণ যা-ই হোক, সহিংসতা মোকাবিলার এই ব্যর্থতার মধ্যেই এই মানবিক বিপর্যয়ের সূত্র খোঁজা চলছে বিভিন্ন মহলে। প্রকাশ্য হামলাকারীদের ঠেকানোয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা ঘিরেই প্রশ্নগুলো জ্বলন্ত।

চাঁদপুরের বিক্ষোভকারীদের গুলি চালিয়ে যত দ্রুত ছত্রভঙ্গ করা গেছে, তত দ্রুত পুলিশ যায়নি রংপুরের পীরগঞ্জে। হ্যাঁ, পুলিশি পাহারা অবশ্য ছিল। তবে সেটা পাশের গ্রামে। আক্রান্ত গ্রামে পুলিশ আসে পুড়ে সব শেষ হওয়ার পরে। জেলা প্রশাসনই বা কী করেছে। কী করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রতাপশালী নেতারা! তাঁদের তৎপরতা নিষ্ফল, বক্তব্য দিশাহীন, ভূমিকা বিতর্কিত।

বিচারহীনতাই সাম্প্রদায়িকতার আশকারা

গত এক দশকে নাসিরনগর, শাল্লা, রামু, সাঁথিয়ায়; যেখানেই হিন্দু-বৌদ্ধরা আক্রান্ত হয়েছেন, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও জড়িত থাকার বিষয়টি এসেছে। এমনকি কেউ কেউ দলীয় পদও পেয়েছেন। রামু হামলা নিয়ে করা নাগরিক অনুসন্ধান কমিটি (২০১২) বা পাবনার সাঁথিয়ায় (২০১৩) সাম্প্রদায়িক হামলার পরে সরেজমিন দেখা গেছে সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা। সাঁথিয়ায় সাংসদ পদের মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের দুজন নেতার রেষারেষি হামলায় ইন্ধন দিয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। তাই প্রশ্ন স্বাভাবিক যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং উদাসীনতা ছাড়া জনগণের একাংশের ওপর এমন হামলা পরিচালিত হতে পারত কি না।

দ্বিতীয়ত, কোনো নাগরিকের জান–মাল-সম্মানের ক্ষতি করা ফৌজদারি অপরাধ। এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ চালালে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে তার বিচার হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হামলার বেলায় প্রথমে জনমতের চাপে শত থেকে হাজার মানুষের নাম মামলায় আসে, গ্রেপ্তারও কিছু হয়, কিন্তু প্রকৃত হোতারা আড়ালে বা বিচারের বাইরে থেকে যায়। ব্যক্তির ওপর করা অপরাধের চেয়ে সাম্প্রদায়িক অপরাধ কি কম অপরাধ?

রাজনৈতিক কূটচাল ও প্রান্তিক করে রাখা জনগোষ্ঠী

পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারপক্ষ বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের কথা বলে, বিরোধীরা দায়ী করে সরকারকে। এসব সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে ওঠে, তাকে ব্যবহার করা হয় বিরোধী দমনের কাজে। এবারও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছেন। কথা হচ্ছে, এটা বলে বা তাদের দমন করেও তো সমস্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। যেহেতু ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছে, সেহেতু অন্য পক্ষগুলো পেয়ে যাচ্ছে দায়মুক্তি। এটা তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেওয়ার শামিল। মাঠপর্যায়ের কিছু বিএনপি-জামায়াত বা অন্য কোনো ইসলামি দলের অনুসারীরা সন্ত্রাসী দঙ্গলে মিশে যেতে পারেন। সমাজবিজ্ঞানে বেনিফিশিয়ারি বা লাভবান পক্ষ বলে একটা কথা আছে। আওয়ামী লীগের বিশাল সাংগঠনিক শক্তি কি রক্ষক না ভক্ষক, সেটা প্রমাণ করতে হবে তাঁদেরই।

রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে দোষারোপ করেই দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। বিএনপির তরফ থেকে আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মাঠে নামলে সরকার যদি তাদের ‘হামলাকারী’ বলে গ্রেপ্তার করে? যেহেতু বিএনপি প্রধান সন্দেহভাজন, সেহেতু নিষ্পেষণের ভয়ে তাদের পক্ষে এগিয়ে আসা কঠিন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ কি দায় এড়াতে পারে?

বাংলাদেশের হিন্দু সমাজকে কাঁদিয়ে, তার জন্য মুসলমানদের অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কার লাভ? সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যে অবিশ্বাসের আগুন, যে বিভেদের পরিখা তৈরি করা হয়েছে, তা দেশের সব ধর্মের মানুষের জন্যই অমঙ্গলজনক। এই অমঙ্গলের ছায়া দূর করার দায়িত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠেরই বেশি। উসকানিতে চটে যাওয়া অপরিণত মানসের লক্ষণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যালঘু নির্যাতন চেয়ে চেয়ে দেখতে পারেন না। ইসলাম অবমাননার নামে হামলা পরিচালিত হলে এই দায় আপনা থেকেই অধিকাংশ বাংলাদেশির ওপর বর্তায়। বাংলাদেশে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি কেউ দেয় না। তবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের হাওয়া আছে। দীর্ঘদিনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছাড়াও এ রকম পরিস্থিতি তৈরি করা কঠিন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ঘৃণার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে না এলে, কথায় ও কাজে নিপীড়িতের পাশে না দাঁড়ালে আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির কলঙ্কায়ন থামানো যাবে না। সংখ্যাগুরু সমাজের মানুষ কি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত?

হিংসার বীজতলা

মানুষের হাহাকার আর নেওয়া যাচ্ছে না। হিন্দু সমাজকে আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকেই যেন আক্রমণ করা হচ্ছে। নতুন বিভেদের ফাঁস তৈরি করা হচ্ছে। দেশ মানে এক দলের, এক ধর্মের, এক জাতের জনসংখ্যা নয়। দেশের ওপর সব দেশবাসীর মালিকানা স্বীকার করেই এগোতে হবে। সাঁথিয়ারই এক মুসলিম সবজিচাষি বলেছিলেন, ‘বারো জাতি ছাড়া দেশ হয়?’ পরিচয় ভিন্ন হবে, কিন্তু সবার জন্য একই মানবতা আর নাগরিক সুরক্ষার চেষ্টা ছাড়া রাষ্ট্রও কি হয়?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।

[email protected]