'বিদ্রোহী প্রার্থী'র ওপর নিষেধাজ্ঞা কেন?

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

সংসদ নির্বাচনে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাঁকে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বলা হয়। বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর বাধানিষেধ আরোপের লক্ষ্য হলো দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এর মাধ্যমে আসলেই কি তা হবে? আমাদের আশঙ্কা যে এ ধরনের বাধানিষেধের ফল বিপরীত হতে পারে। এতে প্রধান দলগুলোতেই বিদ্রোহ হতে পারে। এ ছাড়া আরও অনেক সম্ভাব্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিও রয়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কার্যকারিতাকেই ব্যাহত করবে।
২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা ১২(৩ক) অনুযায়ী: ‘উপধারা (২)-এর অধীন দাখিলকৃত মনোনয়নপত্রের সঙ্গে নিম্নবর্ণিত দলিলাদি সংযুক্ত করতে হবে—(ক) স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন-সংবলিত স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা: তবে শর্ত থাকে যে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী ইতোপূর্বে জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে উক্ত তালিকা প্রদানের প্রয়োজন হবে না; (খ) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা সমপর্যায়ের পদাধিকারী স্বাক্ষরিত এই মর্মে একটি প্রত্যয়নপত্র যে, প্রার্থীকে ওই দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে: তবে শর্ত থাকে যে, কোনো নিবন্ধিত দলের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করা যাবে এবং একের অধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করা হলে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পূর্বেই একজন চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থীর নাম রিটার্নিং অফিসারকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে।’
অর্থাৎ, নিবন্ধিত দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ওপর গত নির্বাচন কমিশনের আমলেই বাধানিষেধ আরোপ করা হয়। তবে আগের নির্বাচন কমিশন দলের মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট পদ্ধতির প্রস্তাব করেছিল, যা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অধ্যাদেশের ধারা [৯০খ(১)(খ)(রা)] অনুযায়ী, ‘কোনো রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে ধারা ৯০ক-এর বিধান অনুসারে নিবন্ধিত হতে চাইলে... (রা) সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা বা ক্ষেত্রমত থানা ও জেলা কমিটির দলীয় সদস্যগণ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর প্যানেল তৈরি করবে এবং কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড উক্ত প্যানেল থেকে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে।’ অর্থাৎ, দলীয় মনোনয়ন নির্ধারণের লক্ষ্যে একধরনের ‘দলীয় প্রাইমারি’র বিধান অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দলীয় মনোনয়ন প্রদান-সম্পর্কিত এ ধরনের বিধান-সংবলিত অধ্যাদেশের অধীনেই ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যদিও বিএনপি বিধানটির প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেনি এবং আওয়ামী লীগ নামকাওয়াস্তে চেষ্টা করে। কিন্তু নির্বাচনের পর নবম জাতীয় সংসদ অধ্যাদেশটি অনুমোদনকালে দলের তৃণমূলের কমিটিগুলো কর্তৃক তৈরি প্যানেল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার পরিবর্তে প্যানেলটি বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন দেওয়ার বিধান করা হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। কারণ, এর ফলে দলের কর্তাব্যক্তিদের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়ে যায়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে অতীতের মতো দলের পক্ষ থেকে যেকোনো বসন্তের কোকিলকে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি এবং দলের নেতা-কর্মীদের মতামত নেওয়ার বিষয়টি ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের গত ২৫ জুলাই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আরপিওর খসড়া বিলে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর বাধানিষেধটি আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আরপিওর ধারা ১২(৩ক) সংশোধন করে দলকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ও প্রত্যাহার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত মনোনয়নপ্রার্থীর নাম রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছানোর সময় মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পূর্বের পরিবর্তে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিনকে ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ, অন্তিম মুহূর্তে এসে দলের চূড়ান্ত মনোনয়নের সিদ্ধান্ত জানা যাবে এবং কেউ এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করলেও লাভ হবে না। কারণ, দল কর্তৃক চূড়ান্তভাবে মনোনীত ব্যক্তির নাম রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হলে দলের প্রাথমিকভাবে মনোনীত এবং দলের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে দাখিল করা অন্য সব মনোনয়নপত্র এরই মধ্যে বাতিল হয়ে যাবে।
অনেকেরই মনে আছে যে গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল-৩ উপনির্বাচনে আমানুর রহমান খান রানা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও মনোনয়নপত্রের সঙ্গে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা জমা দিয়েছিলেন। তিনি দলের মনোনয়ন পাননি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন। (তাঁর বিজয়ের বৈধতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দলের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর, বিদ্যমান আইনের অধীনে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা যায় কি না, সে ব্যাপারে অনেকেরই ভিন্নমত রয়েছে।) কিন্তু আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো সংসদে পাস হলে প্রার্থীদের পক্ষে দলের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ও প্রত্যাহার করার এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং জনাব রানার মতো দলের মনোনয়ন চেয়ে কেউ আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অর্থাৎ, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ন্ত্রণে দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লক্ষণীয় যে বিদ্যমান আইনে সাবেক সাংসদেরা ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা না দিয়েও সংসদ নির্বাচন করতে পারতেন। কিন্তু আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে একবার দলের মনোনয়ন চাইলে এবং দলের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রত্যয়নপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিলে তাঁরা আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবেন না। কারণ, দলের চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলে তাঁদের মনোনয়নপত্রও প্রত্যাহার হয়েছে বলে গণ্য হবে।
প্রসঙ্গত, স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সম্ভাব্য একটি আইনি জটিলতা রয়েছে। ভোট প্রদান একটি গোপনীয় বিষয়, যা নিশ্চিত করার জন্য আরপিওতে একাধিক বিধান রয়েছে। যেমন ধারা ৮২ ও ৮৩ অনুযায়ী, ভোটের গোপনীয়তা ভঙ্গ করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তাঁর সমর্থনকারীদের নাম প্রকাশে বাধ্য করা আরপিওর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করি। এ ছাড়া নাম প্রকাশের কারণে বড় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকেরা হুমকির শিকার হতে পারেন।
আরপিওর প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে দলের কর্তাব্যক্তিদের, বিশেষত আমাদের দুই বড় দলের প্রধানদের মনোনয়ন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হবে। যেহেতু বিদ্যমান আইনি বিধান অনুযায়ী [৯০খ(১)(খ) (রা)] দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের তৈরি প্যানেল থেকে মনোনয়ন দিতে হবে না এবং মনোনয়নপ্রার্থীর ন্যূনতম তিন বছর দলের সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা [ধারা (১)(ঞ)] মানা হয় না, তাই দলীয় প্রধানগণ খেয়াল-খুশিমতো যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে মনোনয়ন দিতে পারবেন। (বাংলাদেশের বাস্তবতায়, দলীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড নিতান্ত রাবার স্ট্যাম্পিং বডি হিসেবে তা অনুমোদন করবে।) ফলে দলের কেউই, বিশেষত নেত্রীদের বিরাগভাজনরা মনোনয়নপ্রাপ্তির বিষয়ে নিরাপদ বোধ করবেন না। এমনই পরিস্থিতিতে দলের মনোনয়ন পাবেন না বলে যাঁরা প্রায় নিশ্চিত, তাঁদের পক্ষে আগে থেকেই ভিন্ন বিকল্পের কথা ভাবাই স্বাভাবিক। তাই এসব সম্ভাব্য বঞ্চিতকে নিয়ে ভবিষ্যতে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ, দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রহিত হওয়ার কারণে দলে বিদ্রোহও ঘটে যেতে পারে। এ জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে কিছু ব্যক্তির অনুঘটকের ভূমিকা পালন।
বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর কঠোর বাধানিষেধের আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিও আমাদের ভোগ করতে হবে। এর ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। কারণ টাকা-পয়সার বিনিময়ে হলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা চাইবেন তাঁদের মনোনয়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক। আর মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে এবং রাজনীতি আর ব্যবসা একাকার হয়ে পড়বে।
বিদ্রোহী প্রার্থী বন্ধ করার পেছনে নির্বাচন কমিশনের যুক্তি হলো যে এর ফলে রাজনৈতিক দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এ দায়িত্ব কমিশনের নয়। কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এর দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, যাতে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও কার্যকর হয় এবং এর দায়বদ্ধতা এ দেশের ভোটারদের কাছে, রাজনৈতিক দলের কাছে নয়। এ ছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকলে নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা কমে যাবে এবং ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিধিও ছোট হয়ে আসবে। আর কম প্রার্থী মানে কম যোগ্য প্রার্থী এবং নির্বাচনে কম যোগ্য প্রার্থী দাঁড়ালে স্বাভাবিকভাবেই কম যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। এতে আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিশেষে, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। কারও কারও মতে, এটি মৌলিক অধিকার। দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকের এই অধিকার হরণ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।