শিক্ষা দিবসে সময়ানুগ শিক্ষাভাবনা
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ৬১ বছর পূর্তির দিন। এর সূচনা হয়েছিল অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, গণমুখী শিক্ষা প্রসার, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য-বঞ্চনা নিরসন তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে। এর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ১৯৬২ সালে শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ। এর শিক্ষায় অর্থ সংস্থান–সম্পর্কিত প্রস্তাব ও মন্তব্য ছিল: ১. শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়। ২. অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল ও নামমাত্র বেতনের মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করাই জনসাধারণের রীতি। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা বস্তুত অবাস্তব কল্পনামাত্র।
এ কমিশনের যে সুপারিশ বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনকে তীব্রতর করে ও আশু কারণ হিসেবে দেখা দেয়, তা হলো—দুই বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদি করার সুপারিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার।
প্রথমে আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা কলেজ থেকে। তিন বছরের ডিগ্রি পাস কোর্সের বিপক্ষে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ডিগ্রির প্রতিবন্ধী ছাত্র এম আই চৌধুরী এ আন্দোলনের সূচনা করেন। উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজিকে অতিরিক্ত বোঝা মনে করে এ স্তরের পরীক্ষার্থীরাও আন্দোলন শুরু করেন। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কলেজে এ আন্দোলন চলতে থাকে। স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের লাগাতার ধর্মঘট এবং উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্রদের ইংরেজি ক্লাস বর্জনের মধ্যে এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। জুলাই ধরে এভাবেই আন্দোলন চলে। ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে সংগঠন পরে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন চালাতে থাকে।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, ‘তবে আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে ১০ আগস্ট (১৯৬২)। এদিন বিকেলে ঢাকা কলেজ ক্যানটিনে স্নাতক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় শ্রেণির ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হয়। এ সভার পূর্বপর্যন্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কমিশনবিরোধী আন্দোলনের কোনো যোগসূত্র ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করতেন, শুধু শিক্ষার দাবি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। ১০ আগস্টের এ সভায় ১৫ আগস্ট সারা দেশে ছাত্রদের সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের কাছে তা ব্যাপক সাড়া জাগায়। এরপর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এক প্রেসনোটে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। অন্যথায় পরিস্থিতি মারাত্মক হবে বলে হুমকি প্রদান করে। এমতাবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বর কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলেও ছাত্ররা ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়। ব্যাপক প্রচারের সাথে চলতে থাকে পথসভা, খণ্ডমিছিল। ব্যবসায়ী সমিতি, কর্মচারী সমিতি, রিকশা ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শহীদ হন নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাসের কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লা।’
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের শিক্ষা নিয়ে ধারণার অনেক পরিবর্তন ঘটলেও কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি। এ রিপোর্টের মূল নির্যাস অক্ষুণ্ন রেখে প্রণীত ২০১০ সালের শিক্ষানীতিরও কাঙ্ক্ষিত পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, প্রায় দুই যুগ আগে প্রণীত কারিকুলাম সংস্কার, শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে ক্লাস শুরু, পরীক্ষার ফল প্রকাশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ, ছাত্রী উপবৃত্তির পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে দরিদ্র ছাত্রদের জন্য উপবৃত্তি চালু, জেন্ডারবৈষম্য হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ। তবে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন ও কোচিং–বাণিজ্য বন্ধের কথিত উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
শিক্ষায় বিরাজিত মুখ্য চ্যালেঞ্জগুলো হলো: ১. স্বল্প বরাদ্দ, ২. শিক্ষকতায় মেধাবীদের আকর্ষণহীনতা, ৩. মেধার অপচয় ও পাচার, ৪. আশঙ্কাজনক হারে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, ৫. শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ফলপ্রসূ তদারকির অনুপস্থিতি, সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতি, ৬. অপর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ৭. পাঠদানে শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অদক্ষতা ও শিক্ষার্থীর শারীরিক শাস্তি, মানসিক নির্যাতন, ৮. শিক্ষকদের একাংশের নৈতিক অবক্ষয়, ৯. প্রায় এক যুগেও সমন্বিত শিক্ষা আইন চূড়ান্ত না হওয়া, ১০. শিক্ষাক্রম/পাঠ্যসূচির সঙ্গে কর্মসংস্থান/শ্রমবাজারের সংস্রবহীনতা, ১১. শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য পরিসংখ্যানে অসংগতি, ১২. শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক-প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সংযোগহীনতা, ১৩. শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার অনুকূলে বিবেচ্য বিষয়গুলো
১. ইনচিয়ন ঘোষণার আলোকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ। ২.অতি কেন্দ্রীভূত বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনার (প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থায়নসহ) বিকেন্দ্রায়ন। ৩. শিক্ষার্থীর জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের পাঠ সম্ভব করে তুলতে অঞ্চল ও এলাকাভিত্তিক শিক্ষক বিনিময়ব্যবস্থা চালু। ৪. প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সময়সীমা হ্রাসের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা। ৫. ইউনেসকো ঘোষিত ২০১৫ সালের শিক্ষকনীতি ও স্কুল নেতৃত্বসংক্রান্ত সুপারিশ সক্রিয় বিবেচনা। ৬. জনসংখ্যা ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ প্রদান এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা/সিটি করপোরেশনগুলোকে শিক্ষায় অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুনর্বিবেচনা। ৭. শিক্ষার্থীর জেন্ডারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিচালন ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও সহশিক্ষার সমসাময়িক উপযোগিতা নির্ধারণ। ৮. কোচিং–বাণিজ্য নিরসনে প্রতিকারমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: যে কারণে ও পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়, তার অবসানকল্পে শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণে পশ্চাৎপদ শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার/সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রতিকারমূলক (রিমিডিয়াল) ও সমযোগ্যতা অর্জনে সহায়ক (লেভেলিং) প্রতিষ্ঠান স্থাপনপূর্বক প্রচলিত কোচিং–বাণিজ্যের নিরসন। ৯. শিক্ষায় করোনার পূর্বাপর পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন ও উত্তরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুসৃত পন্থা, প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সে আলোকে ও অভিজ্ঞতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
কয়েক শতাব্দীর বিবর্তনে বিগত দুই যুগের বেশি সময়ে শিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণ লক্ষণীয়। তবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ও সর্বশেষ ২০১৫–এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য হলেও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব পরিসরে সমযোগ্যতার ভিত্তিতে সমকক্ষতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সে জন্য শিক্ষার সময়ানুগ উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিরাজিত বিষয়গুলো চিহ্নিতকরণ ও উত্তরণের পথনির্দেশনা শিক্ষা দিবসে অতীব গুরুত্ববহ।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ ৬২ শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০- প্রণয়ন কমিটির সদস্য।
ই-মেইল: [email protected]