আর্কাইভসের গুরুত্ব ও ইতিহাসের খোলা সত্য নিয়ে কিছু প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস (৯ জুন) উপলক্ষে আজ এ লেখার অবতারণা করছি। কী বিষয়ে লিখব, এমন ভাবনা যখন আমাকে পেয়ে বসেছে, তখনই এমন দুটি বিরল বিষয়ের কথা মনে পড়ল, যার সঙ্গে ইতিহাসের গভীর তাৎপর্যময় ঘটনাবলি এবং ‘নগ্ন সত্য’ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। একই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের কিছু গবেষকের পরিশ্রমহীনতা ও একাধিক উৎস থেকে তথ্য যাচাই করতে অনীহার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। এই লেখায় আজ আমি তুলে ধরব ইতিহাস গবেষণায় একজন গবেষককে কী পরিমাণে সতর্ক হতে হবে; সত্যনিষ্ঠ, পরিশ্রমী হতে হবে এবং যে সময়ের ইতিহাস তিনি লিখছেন, সেই সময়ে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তা জানতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে এই প্রসঙ্গে।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতিহাস লেখার পদ্ধতিতে মৌখিক/কথ্য ইতিহাস ‘বিপ্লব’ নিয়ে আসে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তা, সৈনিক, রাজনীতিক সবাই স্মৃতিকথা লিখে যান, গবেষক ও মিডিয়ার কর্মীরা তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করেন। বিশেষ করে বিজয়ী ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় তাঁদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শুরু হয় বিজয়ী দেশগুলোর ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের নতুন ‘উন্মাদনা’, যা সংবাদপত্রের যুগ পেরিয়ে রেডিও ও টেলিভিশনের যুগে প্রবেশ করে এবং যুদ্ধের ইতিহাস নিয়মিত বা প্রাত্যহিক কিংবা সাপ্তাহিক ‘ব্রেক ফাস্ট নিউজ’ অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে যায়। তখন এসব মৌখিক ইতিহাস সাড়া ফেলে দেয়।

এ ছাড়া বি-উপনিবেশায়নের যুগে এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা, সংগঠক ও কর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, তাঁদের লেখা আত্মজীবনী, ব্যক্তিগত ডায়েরি ইত্যাদি ইতিহাস লেখার নিত্য নতুন উপাদান হিসেবে সংযুক্ত হতে থাকে। তবে স্মৃতিভ্রম ও এককালের ঘটনা অন্য কালে বর্ণনার সময় মানবসন্তান, তা যেকোনো দেশের হোক না কেন ‘রংচং’ মাখিয়ে অথবা ইচ্ছা করে অথবা কিছুটা হলে বাড়িয়ে বলেন।

এসব উপাদান আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্কাইভসেও সংরক্ষণ করার বিষয়টি চালু হয়। ফলে একসময় যেমন গবেষক ও ঐতিহাসিকেরা প্রধানত নির্ভর করতেন সরকারি দলিলপত্র, সভা-সমিতির কার্যবিবরণী ও গাণিতিক বিভিন্ন তথ্য, যেমন প্রতি একরে খাদ্যশস্য উৎপাদন, আদমশুমারি কিংবা নির্বাচনের ভোটার তালিকা, প্রদত্ত ভোট ও নির্বাচনের ফলাফল ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।

এখন এসবের পাশাপাশি নতুনভাবে এসে যুক্ত হয় মৌখিক ইতিহাস। আর্কাইভসে সংরক্ষিত দলিলপত্রের ওপর প্রধান নির্ভরতা বর্তমান সময়ে যে হ্রাস পেয়েছে, তা নয়। বরং গবেষকের খাটুনি, সতর্ক পর্যবেক্ষণ যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমনি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আর্কাইভস বা মহাফেজখানায় প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করার মতো কঠোর পরিশ্রমের বিষয়টি নতুনভাবে সংযুক্ত হয়েছে।

ঔপনিবেশিক আমলে দেশে বা বিদেশের বিভিন্ন মহাফেজখানায় সংরক্ষিত দলিলপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এসব মহাফেজখানা বা আর্কাইভসে একজন গবেষক নিয়মিত এবং গভীর অভিনিবেশসহকারে যদি মনোনিবেশ করেন, তবে ১৯৪০-এর দশকে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যে যুগান্তকারী এবং ‘জীবন বদলে দেওয়া’ ঐতিহাসিক ঘটনাবলি সংঘটিত হয়েছে, যেমন নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতির ইতিহাস, রাষ্ট্রগুলোর সীমানা নির্মাণ কিংবা প্রতি-নির্মাণ, জাতি, ধর্ম, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বিশ্ববীক্ষা নিয়ে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের মধ্যকার বিতর্ক, দ্বিধা অথবা ‘স্বপ্ন রাষ্ট্রের সন্ধানে’ দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিমাংশে ইতিহাসের বৃহত্তম আঞ্চলিক অভিবাসন সম্পর্কে অনেক পিলে চমকানো তথ্য পাওয়া যাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায় অনেক গবেষক মূল আকর দলিল, যা আর্কাইভসে সংরক্ষিত রয়েছে, তা ভালোভাবে খুঁজে না দেখে অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলেন। গবেষণার প্রচলিত যে পদ্ধতি অর্থাৎ একাধিক উৎস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও অবহেলা দেখান, দ্বৈতীয়িক উৎস কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালে সংঘটিত সিলেট গণভোট নিয়ে পরবর্তীতে কীভাবে বিভিন্ন বই গবেষণায় তথ্য বিকৃতি ঘটেছে তার দৃষ্টান্ত আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা দেন, ব্রিটিশ ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হবে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হবে। একই ঘোষণায় বলা হলো, ১৮৭৪ সালে বাংলায় যেসব জেলা ও অঞ্চল নতুন প্রদেশ আসামে যুক্ত করা হয়েছিল [যেমন রংপুর বিভাগের গোয়ালপাড়া, কাছাড় জেলা, সিলেট ইত্যাদি] তার মধ্যে কেবল সিলেট জেলা ভারত না পাকিস্তানে যুক্ত হবে, তা ওই জেলায় অনুষ্ঠিতব্য গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে।

মাউন্টব্যাটেন এই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন। তখন আসামের গভর্নর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত স্যার আকবার হায়দারী, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন, রাজনৈতিক মতাদর্শে ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সহযাত্রী, যাঁরা ভারত বিভাগ ঠেকাতে জীবনের সর্বস্ব বাজি ধরেছিলেন।

অন্যদিকে গণভোটের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এইচ সি স্টক। এই এইচ সি স্টক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি সৈন্যদের হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা পড়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ অভিযোগ করেছিল যে সেই থেকে তিনি ‘তুর্কি টুপি’ যাঁরা পড়তেন (বিশেষত মুসলিম), তাঁদের ঘৃণা করতেন। অন্যদিকে ‘সিলফোর্স’অধিনায়ক ছিলেন রাজকীয় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মহিন্দর সিং চোপাড়া। ঘটনাক্রমে মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন বলদেব সিং, যিনি একজন শিখ।

একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ তখনই সঠিক ও অভ্রান্ত হবে, যদি তা তথ্যভিত্তিক হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রমাণ হলো আর্কাইভসে সংরক্ষিত দলিলপত্র। এ ছাড়া একজন গবেষককে অন্যান্য তথ্যরাজি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে উপস্থাপন করতে হবে। অবশ্য ঔপনিবেশিক, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপনিবেশ-উত্তর সরকারি ভাষ্যে হয়তো সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় এবং এলিট বা ক্ষমতাবান শ্রেণির উৎপাদিত দলিলপত্রে নিম্নবর্গীয় মানুষের কথা এবং তাদের সামগ্রিক জীবনচিত্র খুব কমই দৃশ্যমান হয় অথবা এমনভাবে ঢাকা থাকে যে গবেষকদের সতর্ক হয়ে অন্যান্য উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে হয়।

তথাপি সমকালীন সরকারি দলিলপত্রে যেমন গাণিতিক অনেক তথ্যরাজি থাকে, যেগুলোর মূল্য অনেক। আমি যে প্রথম ঘটনাটির কথা বলছি সেখানে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে কীভাবে ভোট হয়েছিল, তার একটি পরিষ্কার চিত্র ও রূপরেখা রয়েছে। কারা ভোট দিতেন ও ওই বছর সিলেট জেলায় কত ভোট ছিল এবং সর্বোপরি কতসংখ্যক চা-শ্রমিকের নাম ভোটার তালিকায় ছিল ইত্যাদি আকর ও অবিকৃত তথ্য রয়েছে। দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে সিলেটে যে গণভোট হয়, তা হয় ১৯৪৬ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী। গণভোটে ভোটার তালিকায় নাম থাকা ১১ হাজার ৪৪৯ জন চা-শ্রমিক ভোট দেননি বা দিতে পারেননি। গণভোটে প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার ভোটে সিলেট তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশ ও ভারত এবং ব্রিটেনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে এ-সংক্রান্ত দলিলপত্র রয়েছে এবং যেকোনো গবেষক যদি সিলেট গণভোটে চা-শ্রমিকেরা কেন ভোট দেননি বা দিতে পারেননি জানতে চান এবং এই জটিল বিষয়ে গবেষণা করতে চান, তাহলে তাঁকে অবশ্যই দ্বৈতীয়িক উৎসে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে তা তীক্ষ্ণ গবেষণা প্রশ্নের কাঠামোর মধ্যে ফেলে আর্কাইভসের দলিলপত্র থেকে তথ্য আহরণ করতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের অপেশাদার ঐতিহাসিক কিন্তু শক্তিশালী লেখকেরা সিলেটের গণভোটে চা-শ্রমিকের ভোট-সংক্রান্ত বিষয়ে অতিরঞ্জিত, বিকৃত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাল্পনিক তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এই গণভোটে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি সিলেট যাতে আসামে তথা ভারতে সংযুক্ত হয়, সে জন্য একটি যৌথ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে। এর প্রধান ছিলেন সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক চঞ্চলকুমার শর্মা।

তিনি ১৯৮৪ সালে ‘শ্রীহট্টে বিপ্লববাদ এবং সিলেট জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন: স্মৃতিকথা’ শিরোনামে আত্মজীবনীমূলক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে তিনি জানতেন, কীভাবে তখন ভোট হয়েছে এবং প্রায় সাড়ে ১১ হাজার চা-শ্রমিক ভোটার ছিলেন; অথচ আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘দুই লক্ষাধিক চা-শ্রমিককে যদি অন্যায়ভাবে গণভোট থেকে বাদ না দেওয়া হতো, তা’হলে ভোটের ফলাফল অন্য রকম হতো বলে ভাবার কারণ আছে।’

অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের প্রকৃত তথ্য ব্যবহার না করে তিনি নিজের মতো করে অতিরঞ্জিত করেছেন। একইভাবে আরেকজন অংশগ্রহণকারী জন্মজিৎ রায়ও চা-শ্রমিকদের ভোট প্রসঙ্গে বাস্তবে কী ঘটেছিল, সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। কারণ তিনিও লিখেছেন, চা-বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ হিন্দু ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল; যদি তাদের ৪০ শতাংশদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো, তবে ফলাফলের মোড় ঘুরে যেত।

যাহোক, তাঁদের দুজনের কারও বক্তব্যই সঠিক নয়। কারণ শ্রমিকদের ভোটসংখ্যা দেড় লাখ নয়, ছিল ১১ হাজার ৪৪৯। তাঁরা নিম্নোক্ত কারণে ভোট দিতে পারেননি [যদি তাঁরা সবাই আসামে যুক্ত হওয়ার জন্য ভোটও দিতেন, তবে ৫৫,৫৭৮-১১,৪৪৯ = ৪৪,১২৯ ভোটে সিলেট পূর্ব বাংলায় যুক্ত হতো]।

১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে যে ভোট হয়েছে সেখানে সব কৃষক-শ্রমিক ভোটার ছিলেন না। কৃষকদের মধ্যে যাঁরা ৯ আনা পরিমাণে কর দিতেন তাঁরা ভোট দিতেন। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা যাঁদের ছিল তারা এবং চা-শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা স্থায়ী চাকরি করতেন, তাঁদের নামই ভোটার তালিকায় ছিল এবং তাঁরা ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে (চা-শ্রমিক ছাড়া) ভোট দেন।

সিলেটের মোট জনসংখ্যার ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। উচ্চবর্ণের হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং উপজাতি মিলে ছিলেন প্রায় ৩৯ শতাংশ। তথাপি সিলেট জেলায় ভোটার তালিকায় মুসলিম ভোটার ছিলেন ৫৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। এই অসংগতি নিরসনে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খান মাউন্টব্যাটেনকে লেখা একটি চিঠিতে দুটি দাবি উত্থাপন করেন।

এক. সিলেটের বর্তমান ভোটার তালিকায় মুসলিমদের যে ভোট, তা তাদের প্রকৃত সংখ্যাকে প্রতিফলন করছে না। এর প্রতিকার করতে তিনি যুক্তি দেখান যে বাদ পড়া মুসলমানদের নতুন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
দুই. ভোটার তালিকায় থাকা ১১ হাজার ৪৪৯ জন চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তিনি যুক্তি দেখান যে চা-শ্রমিকেরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ বছর আগে সিলেটে এসেছেন। তাঁরা এই জেলার ভূমিপুত্র নন। ফলে জেলার ভাগ্য নির্ধারণী গণভোটে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা যৌক্তিক নয়।

লিয়াকত আলী খানের এই চিঠির প্রত্যুত্তরে ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন লেখা ফিরতি চিঠিতে মাউন্টব্যাটেন তাঁকে জানান, লিয়াকত আলী খানের প্রথম পরামর্শ অর্থাৎ বাদ পড়া মুসলমানদের নতুন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তার হাতে এত সময় নেই। ফলে বিদ্যমান নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতেই সিলেটের গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে লিয়াকত আলীর দ্বিতীয় যুক্তি, অর্থাৎ ১১ হাজার ৪৪৯ জন চা-শ্রমিক ভোটারকে গণভোটের বাইরে রাখা হবে তা তিনি মেনে নেন। কারণ তাঁরা জেলার ভূমিপুত্র নন।

প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন দুজন অংশগ্রহণকারী বা প্রত্যক্ষদর্শী পরবর্তীকালে নিজেদের লেখায় কীভাবে ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটে কী ঘটেছিল, সেই ঐতিহাসিক তথ্য নিজেদের মতো করে লিখেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু তার চেয়ে দুঃখজনক হলো, পরবর্তীকালে ভারত ও বাংলাদেশে কিছু লেখক উপরিউক্ত দুজনের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে একের পর এক ‘ইতিহাস’ লিখে চলেছেন।

অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে ২০১৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজে আমি ‘দ্য মেকিং অ্যান্ড আনমেকিং অব আসাম-বেঙ্গল বর্ডারস অ্যান্ড সিলেট রেফারেনডাম’ নামে একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যেখানে আমি চঞ্চলকুমার শর্মা ও জন্মজিৎ রায়ের দেওয়া ‘বিকৃত’ তথ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত সিলেটের গণভোটের দলিলপত্রের আলোকে এবং অন্যান্য অসংখ্য সূত্র উল্লেখ করে খারিজ করে দিয়েছি। কিন্তু এমন অনেক গবেষণা আছে যেখানে দেখা যাবে আর্কাইভে থাকা এসব তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বা দ্বৈতীয়িক উৎস কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেট জেলা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কেউ যদি আর্কাইভসে সংরক্ষিত দলিলপত্র যথাযথভাবে না দেখে খোলা উৎস থেকে তথ্য নিয়ে লিখে ফেলেন তবে তা সত্যিই বিস্ময়কর।

  • আশফাক হোসেন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ এবং পরিচালক, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়