বিশ্ব দুগ্ধ দিবস: বার্ধক্যে সুস্বাস্থ্য ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্ব

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস, বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুন দিবসটি পালিত হয়। এ বছরের দুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সাসটেইনেবল ডেইরি: গুড ফর দ্য প্ল্যানেট, গুড ফর ইউ’; অর্থাৎ টেকসই ডেইরি পরিবেশগত প্রভাবগুলো হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্য ও জীবিকা সরবরাহের বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বিশ্বে গরুর দুধ উৎপাদন ২০১০ সালে ৪৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন থেকে ২০১৯ সালে ৫২৪ দশমিক ৪১ মিলিয়ন টন হয়েছে; অর্থাৎ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (ইউএসডিএ, ২০২০)। বিশ্ব দুগ্ধ উৎপাদনে (৮১ শতাংশ গরুর দুধ, ১৫ শতাংশ মহিষের দুধ এবং ৪ শতাংশ ছাগল, ভেড়া ও উটের দুধ) ২০১৯ সালে ১ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮৫২ মিলিয়ন টন হয়েছে। বিশ্বে দুগ্ধ উৎপাদনে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বড় দুগ্ধ উৎপাদক ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (১৫৫ দশমিক ২ মিলিয়ন টন), যুক্তরাষ্ট্র (৯৯ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন টন), ভারত (৯২ মিলিয়ন টন), জার্মানি (৩৩ দশমিক ১ মিলিয়ন টন) (ইউএসডিএ, ২০২০)। দুগ্ধজাত পণ্যের (মাখন ছাড়া) মাথাপিছু গ্রহণ বিশ্বব্যাপী গড়ে ৭৮ দশমিক ২৪ কেজি (২০১৯) থেকে ১১১ দশমিক ৬ কেজিতে (২০২০) উন্নীত হয়েছে; অর্থাৎ এই সময়ে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (এফএও, ২০২০)।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২১ অর্থবছরে দুধের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন (জনপ্রতি চাহিদা ২৫০ মিলি ধরে), যার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮০ হাজার মেট্রিক টন। ফলে জনপ্রতি দুধের প্রাপ্যতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫ দশমিক ৬৩ মিলি।

মানবজাতিতে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খামার থেকে টেবিল পর্যন্ত টেকসহ পুষ্টির জন্য দুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার খাদ্যতালিকা নির্দেশিকা অনুসারে নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়ার সুপারিশ করা হয়। দুগ্ধজাত খাবার, যেমন পনির ও দই আদর্শগতভাবে হেলদি অ্যাজিং প্রোডাক্ট হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (২০১৫) নির্দেশিকা অনুযায়ী, হেলদি অ্যাজিং হলো কার্যকর ক্ষমতার বিকাশ এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রক্রিয়া, যা বার্ধক্যে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ডি এবং প্রোটিন মানবদেহের জন্য মূল পুষ্টি উপাদান, যা পেশিভর ও গুণমানকে প্রভাবিত করে। দুগ্ধজাত দ্রব্য বয়স্কদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, পেশির স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং স্কেলেটাল মাসল মাস ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সারকোপেনিয়া (বার্ধক্য প্রক্রিয়ার একটি মূল বিবেচ্য বিষয়) প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাই দুগ্ধজাতদ্রব্য বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য হেলদি ফুড হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বয়স্কদের পনির ও দই (প্রোবায়োটিক দই) প্রদানের মাধ্যমে সারকোপেনিয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। অন্যদিকে এ ধরনের পুষ্টিসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ বিপাকীয় রোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রকোপ কমায় এবং কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় (ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ ২০১৬) পাওয়া যায় যে একটি স্বাভাবিক খাদ্যতালিকায় দুগ্ধজাত দ্রব্য যোগ করা হলে এর গুণগতমান বৃদ্ধি পায়; যা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর পেশিশক্তি হ্রাস রোধে সহায়তা করে।

দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। স্বল্প ফ্যাটযুক্ত, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত পণ্যগুলো সাধারণত রক্তচাপ কমায় এবং ২০০-৩০০ মিলি/দিন দুধ গ্রহণে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে না বলে সম্প্রতি গবেষণায় (ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ ২০১৬) পাওয়া যায়। দুগ্ধপ্রোটিন, যেমন কেসিন ক্ষুদ্রান্ত্রে ক্যালসিয়াম ও ফসফেট শোষণকে সহজ করে এবং এটি বায়ো-অ্যাকটিভ পেপটাইড উৎপাদনের প্রধান উপাদান। দুগ্ধজাত পেপটাইডগুলো মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে দুধের প্রোটিনের পরিপাক থেকে উদ্ভূত হয়ে অক্ষতভাবে শোষিত হয়। এই বায়ো-অ্যাকটিভ অণুগুলোর মধ্যে কয়েকটি ল্যাকটোট্রাইপেপটাইড পাওয়া যায়, যা অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইমকে (এসিই) বাধা দিয়ে রক্তচাপ কমায়/নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম (এসিই) একটি ভ্যাসোকন্সট্রিক্টর এবং এটি অ্যালডোস্টেরন নিঃসরণকে উদ্দীপ্ত করে, যা কিডনি দ্বারা সোডিয়াম এবং পানি ধারণ করে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে হেলদি অ্যাজিংয়ে সহায়তা করে।

পরিশেষে, বিশ্বব্যাপী দুগ্ধ খাতের পরিস্থিতির আলোকে আরও গবেষণার প্রয়োজন। বিশেষ করে আরও বেশি পুষ্টিকর দুগ্ধজাত খাবার (হেলদি ফাংশনাল ডেইরি ফুডস), সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যা ভোক্তার হেলদি অ্যাজিংয়ে সহায়তা করবে। তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করে দেহের পুষ্টিচাহিদা পূরণের মাধ্যমে বার্ধক্যে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।

  • ড. এ কে এম এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক (দুগ্ধবিজ্ঞান), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]