কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পর এই হামলার জবাবে কী করা উচিত, তা নিয়ে ভারতের মানুষের মধ্যে এখন আলোচনা চলছে। অনেকে এবং আমি নিজেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতোই মনে করি, অপরাধীদের এমন শাস্তি দেওয়া দরকার, যা তারা কোনো দিন ভুলবে না। তবে আবার কেউ কেউ বলছেন, যুদ্ধ এড়িয়ে চলা উচিত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একসময় বলেছিলেন, ‘এখন আর যুদ্ধের যুগ নয়।’ কিন্তু এটা তো সন্ত্রাসবাদের যুগও হওয়া উচিত নয়। তাহলে ভারতের কীভাবে জবাব দেওয়া উচিত?
প্রথমে ভাবতে হবে, যারা এই হামলা চালিয়েছে, আসলে তাদের চাওয়াটা কী। তাদের লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরে শান্তির পরিবেশ নষ্ট করা। তারা চেয়েছে, যাতে সেখানে পর্যটন বন্ধ হয়ে যায়, স্থানীয় মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়, মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা চেয়েছে, ভারতের অন্য প্রান্তের মানুষ যেন কাশ্মীরিদের অবিশ্বাস করতে শুরু করে। এতে ভারতের ভেতরে বিভাজন বাড়বে, ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়বে। একই সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া যাবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে কাশ্মীর ইস্যুকে আবার তুলে ধরা যাবে। তারা চায়, ভারত-পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবার একসঙ্গে বিবেচনা করা হোক।
এসব কিছুতে যাদের সবচেয়ে বেশি লাভ, তারা হলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তারা যেহেতু নিজের দেশে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, আর দেশের খারাপ অর্থনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে; সেহেতু এসব থেকে দৃষ্টি সরাতে তারা হয়তো এমন কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছে। এই হামলার আগেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির এক বক্তব্যে বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কখনোই ভালো সম্পর্ক হতে পারে না।
তিনি আবার কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার ভেইন’ বা ‘জীবনের শিরা’ বলে দাবি করেন। যদিও বাস্তবে কারও শরীরের বাইরের কিছু কখনো তার শিরা হতে পারে না।
আমাদের এই খারাপ শক্তিগুলোর উদ্দেশ্য সফল হতে দেওয়া যাবে না। এ জন্য প্রথমেই যে জিনিসটি আমাদের করা উচিত নয়, তা হলো আমরা যেন সাধারণ কাশ্মীরিদের দোষ না দিই। এই হামলার ঘটনায় কাশ্মীরিদের কোনো লাভ নেই, বরং এতে তাদের ক্ষতিই হয়েছে।
যদি আমরা শোক ও রাগের বশে কাশ্মীরিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই বা যদি ভারতের বেশির ভাগ মানুষ কয়েকজন সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো একটা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে সন্ত্রাসীরা তাদের উদ্দেশ্যে সফল হবে। আমাদের উচিত কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা, পর্যটনকে উৎসাহ দেওয়া এবং উন্নয়ন চালিয়ে যাওয়া। ভারতের পক্ষ থেকে কাশ্মীরকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার আরও জোরালোভাবে ঘোষণা করা উচিত। পর্যটকদের আবার উপত্যকায় যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
ভারতের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। ভারত আগেও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। সব মিলিয়ে, ভারতের এমন কিছু করা দরকার, যাতে সবার কাছে স্পষ্ট হয় ভারত আর এই সন্ত্রাস সহ্য করবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে, যেন ভারতের উন্নয়ন (যা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার) থেমে না যায়।
একইভাবে আমাদের রাগ যেন নিজেদের দেশের মুসলিম নাগরিকদের দিকে না যায়। কিছু সন্ত্রাসী যদি দাবি করে, তারা সব মুসলমানের পক্ষ থেকে কথা বলছে, সেটার কোনো ভিত্তি নেই। ভারতের অধিকাংশ মুসলমানই শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চান, নিজেদের পূর্বপুরুষদের জন্মভূমিতে অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে, খেলতে, আনন্দ-দুঃখ ভাগ করে নিতে চান। যদি এমন পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে প্রতিটি মুসলমানকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বরং আমাদের উচিত এর উল্টো দিকটা তুলে ধরা। যেমন সেই কাশ্মীরিদের সাহসের কথা তুলে ধরা দরকার, যারা আক্রান্ত পর্যটকদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। সেই পানিওয়ালার কথা, যিনি হামলা থামাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন, কিংবা অসংখ্য ভারতীয় মুসলমান যাঁরা ইন্টারনেটে বলেছেন, ‘এই হামলা আমাদের নামে হতে পারে না।’ এ ধরনের প্রতিবাদগুলো তুলে ধরলে এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামাবাদের কট্টর ইসলামপন্থীরা চায় ভারত যেন তাদের ফাঁদে পা দেয়। তারা চায়, আমরা যেন ঠিক সেই আচরণ করি, যা তারা আশা করে। কিন্তু আমাদের উচিত আমাদের শোকের মধ্যেও নিজেদের ন্যায়পরায়ণ, সবার প্রতি সহনশীল এবং হিন্দু-মুসলমান, কাশ্মীরি-অকাশ্মীরি সবাইকে ভালো জীবনের নিশ্চয়তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হিসেবে প্রমাণ করা।
আমরা যেন নিজেদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করাও শুরু না করি। যা ঘটেছে, তাতে স্পষ্ট যে এটি পরিকল্পিত হামলা ছিল। গোপন নজরদারি, নির্ভুল পরিকল্পনা আর সময় মেনে হামলা চালানো হয়েছিল। মূল দায় তাদের, যারা এই হামলা পরিকল্পনা ও কার্যকর করেছে।
অবশ্যই আমাদের পক্ষেও গোয়েন্দা তৎপরতা ও নিরাপত্তায় ভুল ছিল। সব জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনী থাকা সম্ভব না, আর কোনো দেশেই শতভাগ নির্ভুল গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায় না। ইসরায়েলও এটি ৭ অক্টোবরের ঘটনা থেকে তা শিখেছে।
এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং সরকারকে নিজের স্বার্থেই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই কাজগুলো করার সময় এখন নয়। এখন আমাদের একসঙ্গে থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার সময়।
তাহলে এখন কী করা উচিত
প্রথমত, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। আরেকটি হামলার ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। কাশ্মীর উপত্যকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান আরও কঠোর করেছে। জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত লোকদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বার্তা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।
তবে এখন আর বাড়িঘর ধ্বংস না করাই ভালো, কারণ এতে নিরীহ মানুষের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত শুধু শাস্তি বা প্রতিরোধ নয়, বরং এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে উপত্যকার মানুষ ও পর্যটক—সবাই বুঝতে পারে কাশ্মীর নিরাপদ ও স্থিতিশীল। পর্যটন উৎসাহিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে একদিকে যেমন অর্থনীতির উপকার হবে, অন্যদিকে মানুষের মনে এই সংকটের মধ্যেও স্বাভাবিক জীবনের অনুভূতি ফিরে আসবে।
দ্বিতীয়ত, কূটনৈতিক দিক থেকে আরও তৎপর হতে হবে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এমনিতেই এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে নয়াদিল্লি ইতিমধ্যে প্রায় সব অসামরিক উপায়ে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ফেলেছে। তবুও কূটনৈতিক পর্যায়ে এখন দরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করে পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়ানো। যদিও সরাসরি পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের (যেমন জেনারেল মুনির) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আনা কঠিন হতে পারে, তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ফাঁস করে দিলে পাকিস্তান আরও কোণঠাসা হবে।
ওসামা বিন লাদেন হত্যার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে বদনাম হয়েছিল, সেটি এখন ভারতের কাজে লাগানো উচিত। বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে ভারত যেন এমন পদক্ষেপ নিতে পারে, যাতে পাকিস্তানের আগ্রাসী আচরণ রোধ করা যায়। যেমন পাকিস্তানের জন্য সামরিক সহায়তা বন্ধ করা, যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের উন্নয়ন প্রকল্প বাতিল করা, যন্ত্রাংশ সরবরাহে বিধিনিষেধ আনা, অমানবিক সাহায্য (নন-হিউম্যানিটারিয়ান এইড) কমানো এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে বহুপক্ষীয় অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা।
ভারতের উচিত যেসব পাকিস্তানি সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাদের প্রত্যর্পণের দাবি তোলা, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা তালিকায় তাদের আবার যুক্ত করা এবং ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে এফএটিএর (আর্থিক কারচুপি ও সন্ত্রাসী অর্থায়নবিরোধী সংস্থা) চাপ বাড়ানোর দাবি তোলা।
তবে এসবই যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানকে কড়া বার্তা দিতে হলে আরও শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানো হতে পারে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের বালাকোট হামলার চেয়েও বড় আকারে বিমান হামলা চালানো যেতে পারে, যেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও অবকাঠামোকে লক্ষ্য করা হবে। আবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমেও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ঘাঁটিতে আঘাত হানা যেতে পারে, যাতে ভারতের ক্ষোভ আরও স্পষ্টভাবে বোঝানো যায়।
ভারতের প্রতিক্রিয়া কেবল স্থল ও আকাশপথেই সীমাবদ্ধ না থেকে নৌবাহিনীও এতে যুক্ত হতে পারে। আরব সাগরের উত্তরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানি বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে চাপ তৈরি করতে পারে। এর ফলে বাণিজ্যে বিমা খরচ বাড়বে, পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতি আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং তাদের বিপজ্জনক আচরণের খেসারত আরও বাড়বে।
একদিকে দৃশ্যমান (ওভার্ট) পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যদিকে গোপন (কোভার্ট) অভিযানও জোরদার করতে হবে—যাতে পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী নেতারা এবং তাদের নেটওয়ার্ক সব সময় হুমকির মুখে থাকে। পাশাপাশি ভারতকে সাইবার যুদ্ধের কৌশলও গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের যোগাযোগব্যবস্থা, পরিচালনা ক্ষমতা এবং পুরো অবকাঠামো ভেঙে দিতে হবে।
পাকিস্তান কী করবে
পাকিস্তান সম্ভবত পুরোপুরি যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। কারণ, তাদের সামরিক শক্তি এখন বেশ সীমিত। আর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখানো হলেও বাস্তবে সেটা খুব একটা কাজে আসে না। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে আমরা দেখেছি, পারমাণবিক অস্ত্র সাধারণত হুমকি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়, আসল যুদ্ধের জন্য নয়।
যদি পাকিস্তান এই অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়, তাহলে গোটা দুনিয়ার নজর সেদিকে যাবে। পাকিস্তান ভালো করেই জানে, এমন হুমকি দিলে তার ভয়াবহ ফল হতে পারে। তাই পাকিস্তান সম্ভবত সীমিত পরিসরের কোনো সামরিক সংঘর্ষে যেতে চাইবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় এবং কাশ্মীর ইস্যু আবার আলোচনায় আসে। দেশের ভেতরে এই উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে চাইবে, যেন মানুষ মনে করে, সেনাবাহিনীই দেশের নিরাপত্তার শেষ ভরসা।
ভারতের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। ভারত আগেও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। সব মিলিয়ে, ভারতের এমন কিছু করা দরকার, যাতে সবার কাছে স্পষ্ট হয় ভারত আর এই সন্ত্রাস সহ্য করবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে, যেন ভারতের উন্নয়ন (যা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার) থেমে না যায়।
আমরা কখনোই খুনিদের সামনে মাথা নোয়াব না।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর ভারতের লোকসভার কংগ্রেস পার্টির এমপি
