বৌদ্ধধর্ম কর্মবাদী ধর্ম

বৌদ্ধধর্ম কর্মবাদী ধর্ম বা কর্ম ও কর্মফলে বিশ্বাসী। মহামানব গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরের বাণী কিংবা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মানবসমাজে ধর্ম প্রচার করেননি। বুদ্ধ অনন্ত জন্ম পরিগ্রহ করে ৩০ প্রকার পারমি পূর্ণ করে সর্বশেষ রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মহামায়ার ঔরসে জন্মগ্রহণের পর ২৯ বছর বয়সে রাজ ঐশ্বর্য, পিতামাতা, স্ত্রী-পুত্র—সবকিছু ত্যাগ করে ৬ বছর কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে সহস্র মারসেনাকে পরাজিত করে বৈশাখী পূর্ণিমার সমুজ্জ্বল তিথিতে পরমজ্ঞান বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তাঁর সাধনা দ্বারা যে জ্ঞান অধিগত করেছেন, সেটাই তিনি মানবসমাজে প্রচার করেছেন। তাই বৌদ্ধধর্মকে বলা হয় মানবধর্ম। তিনি মানুষের দুঃখ–মুক্তির ধর্ম জনসমাজে প্রচার করেছেন। তিনি ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেননি।

রাজকুমার সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনটি বিষয় আবিষ্কার করেছিলেন। সেই তিনটি বিষয় হচ্ছে—চার আর্য্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও নির্বাণ। অর্থাৎ মানুষের জীবনে দুঃখ আছে। সেই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় আছে। দুঃখ লাভের উপায় হলো ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’। অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ সব ধরনের দুঃখের অন্তসাধন করে, সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করে বিমুক্ত মানবরূপে নির্বাণ লাভ করতে সমর্থ হন। তাই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করে নির্বাণ সাক্ষাৎ করার জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তথাগত বুদ্ধ যে ধর্ম পৃথিবীতে প্রচার করেছেন, সেটা সম্পূর্ণরূপে নিজের সাধনা দ্বারা অধিগত ধর্ম।

এ ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে জীবনে একটি বাক্যও কারও কাছ থেকে ধার করে তিনি প্রচার করেননি। ভগবান তথাগত বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মকে বলা হয় সদ্ধর্ম বা সত্য ধর্ম। বুদ্ধ বলেছেন, ‘এহিপস্সিকো’। এর অর্থ হলো ‘এসো, দেখো’ অর্থাৎ আগে জানো, নিজের বিবেক–বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করো, যদি সত্য কিংবা যুক্তিসংগত এবং নিজের ও অপরের জন্য কল্যাণময় ধর্ম মনে হয়, তবেই গ্রহণ করো। অন্যথায় বর্জন করো। বুদ্ধ তাঁর মতবাদ কারও ওপর বোঝাস্বরূপ চাপিয়ে দেননি। কাউকে স্বর্গ, নরক অথবা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেননি। তিনি সব সময় ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, ‘ভালো লাগলে গ্রহণ করো, ভালো না লাগলে গ্রহণ কোরো না। অন্ধভাবে কোনো কিছুকে গ্রহণ কোরো না।’ এটা ছিল তাঁর পরিষ্কার কথা।

বৌদ্ধধর্ম সব সময় বাস্তবতায় বিশ্বাস করে। বৌদ্ধধর্ম ঐশ্বরিক ধর্ম নয়, পরিপূর্ণ মানবধর্ম। বুদ্ধ বলেছেন, ‘নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা। নিজে ব্যতীত অন্য আবার কে!’ তাই বৌদ্ধধর্ম জ্ঞানী, পণ্ডিতদের প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ধর্ম। বুদ্ধ আরও বলেছেন, ‘আত্মদীপ প্রজ্বালন করো, নিজের শরণই অনন্য শরণ।’ বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে গিয়ে কাউকে কোনোরকমে ভয় দেখাননি। সবাইকে নিজের কৃতকর্মের প্রতি বিশ্বাস করতে বলেছেন। কেননা কর্মই মানুষের সুখ-দুঃখের প্রধান কারণ। তাই তিনি বলেছেন, ‘সকল প্রকার পাপকর্ম হতে বিরত থেকে কুশলকর্ম সম্পাদন করো এবং স্বীয় চিত্তকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ করো; ইহাই বুদ্ধগণের অনুশাসন।’

বৌদ্ধধর্ম সর্বদা কর্ম ও কর্মফলে বিশ্বাস করে। কুশল বা সৎকর্ম মানুষের জীবনে মঙ্গল, কল্যাণ বয়ে আনে। অকুশল বা পাপকর্ম মানবজীবনে অমঙ্গল, অকল্যাণ বয়ে আনে। ভালো–মন্দ, সুখ-দুঃখ, কল্যাণ-অকল্যাণ সবই নিজের কর্মের মধ্যেই নিহিত, কর্ম দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এর বাইরে বিশ্বাস করার আর কিছু থাকে না। তাই বৌদ্ধধর্ম বাস্তবসম্মত, যুক্তিসংগত ও বিজ্ঞানমনস্ক ধর্ম হিসেবে পৃথিবীতে সর্বজনীন ধর্ম বলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। অন্ধবিশ্বাস, মিথ্যা কল্পকাহিনি, অবাস্তব ধারণা বৌদ্ধধর্ম সমর্থন করে না। বুদ্ধ ঈশ্বর বিশ্বাসকে মিথ্যাদৃষ্টি বলে অভিহিত করেছেন। আর মিথ্যাদৃষ্টিপরায়ণ মানুষেরা জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু—এসব দুঃখ থেকে কখনো মুক্তি লাভের আশা করতে পারেন না।

ভগবান বুদ্ধ তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর উদ্দেশে যে অন্তিম বাণী বলেছিলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ! তোমরা শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার অনুশীলন করো, জ্ঞানের সাধনা করো, পবিত্র পরিশুদ্ধ জীবনের অধিকারী হও। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আমি তোমাদের যে ধর্ম, যে বিনয় শিক্ষা দিয়েছি, তা সুন্দররূপে প্রতিপালন করবে। হীনধর্ম সেবন করবে না। জগতে সংস্কারমাত্রই অনিত্য। যা উৎপন্ন হয়, তা পুনরায় বিনাশ হয়—তোমাদের প্রতি ইহাই আমার শেষ শিক্ষা, ইহাই আমার অনুশাসন।’

পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমার আলোয় সারা বিশ্ব আলোকিত হোক। যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি, অশান্তি চিরতরে বন্ধ হোক।

শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য,

করুণাঘন ধরণীতল, কর কলঙ্কশূন্য।

সবাই মঙ্গল লাভ করুক, সবার কল্যাণ হোক, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

  • ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার; সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন