দ্রুত শনাক্ত করা গেলে স্তন ক্যানসার নিরাময় সম্ভব

১০ অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস। এবার দশমবারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি। এই প্রাণঘাতী ব্যাধি সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন। গ্লোবক্যান ২০২০ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি চারজন নারীর একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে ১২ শতাংশ নারী তাঁদের জীবনের কোনো এক সময়ে স্তন ক্যানসারে ভোগেন। স্তন ক্যানসারের হার উন্নত দেশগুলোতে বেশি, কিন্তু মৃত্যুহার বেশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

অল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে নারীদের স্তন ক্যানসারের সঙ্গে সঙ্গে জরায়ুর ক্যানসারের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। অনুন্নত দেশগুলোতে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের চিত্র আরও ভয়াবহ, দুর্দশাগ্রস্ত ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার কারণে স্তন ক্যানসারের সঠিক ধরন নির্ণয় না করে নামমাত্র চিকিৎসা দেওয়ার কারণে মৃত্যুসংখ্যা বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও সঠিক পরীক্ষা হলে  প্রতিবছর হাজার হা্জার জীবন বাঁচানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি আটজনের মধ্যে একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত শনাক্তকরণ এবং সঠিক চিকিৎসার কারণে বর্তমানে ২ দশমিক ৯ মিলিয়নের বেশি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মার্কিন নারী বেঁচে আছেন।

স্বাভাবিক স্তনের গঠন

মেয়েদের স্তন লোবিউল (দুগ্ধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি), নালিকা বা ডাক (লোবিউল থেকে বোঁটায় দুগ্ধ বহনকারী), ফ্যাটি টিস্যু দিয়ে তৈরী স্ট্রোমা, লোবিউল ও নালিকাগুলোকে পরিবেষ্টনকারী যোজক কলা, রক্তবাহিকা  এবং নলিকাবাহিকার সমন্বয়ে গঠিত। মাতৃদুগ্ধকে পরিশোধিত করে অ্যান্টিবডিজের জন্য শিশুর দুধপান অবশ্যই জরুরি।

স্তন ক্যানসারেন ধরন

স্তন ক্যানসার হলো অতি দ্রুত বৃদ্ধি ও পরিবর্তিত টিউমার। স্তন কোষে  মিউটেশন বা পরিবর্তনের কারণে জেনেটিক অস্থায়িত্ব কোষ তৈরি হওয়াতে যা স্বাভাবিক স্তন কোষকে অস্বাভাবিকরূপে পরিবর্তিত করে; ফলে কোষগুলোকে পার্শ্ববর্তী কোষের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি করে একটি চাকা বা লাম্প তৈরি করে। পরে প্রাথমিক লাম্প এলাকা থেকে দেহের দূরবর্তী বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে।

স্তন ক্যানসারের প্রকারভেদ

ক. হরমোন সেনসেটিভ স্তন ক্যানসার: ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ স্তন ক্যানসার হরমোন রিসেপ্টর পজিটিভ, ম্যালিগন্যান্ট পরিবর্তনের পর এই কোষগুলো ইস্ট্রোজেন এবং অথবা প্রজেস্টেরনের রিসেপ্টর প্রকাশ করে এবং ইস্ট্রোজেন সিগন্যালিং প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে। এ ধরনের স্তন ক্যানসার হরমোনথেরাপি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
খ. হার-২ টার্গেটেড স্তন ক্যানসার: ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর-২ জ্বিন/প্রোটিনে অন্য এক ধরনের মিউটেশন হয়। এই টিউমারগুলো হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর/গ্রোথ হরমোনের প্রতি সেনসিটিভ থাকায় তারা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের টিউমার হার-২ মনোক্লোনোনাল অ্যান্টিবডি দ্বারা বা টার্গেটেড থেরাপি দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গ. ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যানসার: শুধু ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার ট্রিপল নেগেটিভ চিহ্নিত হয়। তার মানে তারা কোনো ধরনের জানা রিসেপ্টর প্রকাশ করে না; বরং জটিল জেনেটিক মিউটেশনের জন্য তাদের আরও গুরুতর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য বিস্তারিত গবেষণা চলছে, যা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

স্তন ক্যানসারের লক্ষণ

* স্তনের আকার ও আকৃতিতে পরিবর্তন।
* স্তনের ত্বকে টোল পড়া বা কুঁচকে যাওয়া।
* বোঁটা বা অন্য অংশ ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া।
* স্তনের বোঁটায় চুলকানি, আঁশযুক্ত ত্বক, ফুসকুড়ি পড়া।
* স্তন ফুলে যাওয়া, গরম হয়ে যাওয়া, লালচে ভাব, কালো হয়ে যাওয়া।
* স্তনের ভেতরে বা বগলে চাকা, শক্ত পিণ্ড।
* কোনো জায়গায় নতুন অনুভূত ব্যথা, যা দীর্ঘস্থায়ী।
* আচমকা স্তন বোঁটা দিয়ে ক্ষরণ।

কারা ঝুঁকিতে থাকেন

ক. পারিবারিক হিস্ট্রিতে রয়েছে স্তন ক্যানসার, এমন নারীরা; খ. মাসিক অনিয়মিতভাবে যাঁদের হয়েছে; গ. ঘন স্তন টিস্যু মেমোগ্রাফির দ্বারা বোঝা যায়;
ঘ. জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করেছেন; ঙ. ডিপো প্রভেরা (ডিএমপিএ) ইনজেকশন নেওয়ার অভ্যাস; চ. হরমোন চিকিৎসা পোস্ট মেনোপজাল সময়ে; ছ. যেকোনো ধরনের ধূমপান, মদ পান; জ. অবিবাহিত বা দেরিতে ছেলেমেয়ে হওয়া; ঝ. ব্রেস্ট ফিডিং বা বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ানো; ঞ. অতিরিক্ত ওজন ও মেদ

দ্রুত শনাক্তকরণ

স্ক্রিনিং পরীক্ষাগুলোর উদ্দেশ্য, লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই ছোট অবস্থায় চাকা খুঁজে বের করা, যেমন একটি চাকা যা হাতে অনুভব করা যায় না, যা রোগী হাত দিয়ে অনুভব করেন কিন্তু তারা এখনো স্তন টিস্যুতেই সীমাবদ্ধ আছে। এ ধরনের স্তন ক্যানসারের কারণ নির্ণয় প্রাথমিক পর্যায়ে বায়োপসি ও মলিকুলার বায়োলজি টেকনোলজি দিয়ে এর ধরন বা টাইপ নির্ণয় করা যায়। যেসব স্তন ক্যানসার লক্ষণ প্রকাশ করছে, অনুমান করা যায়, তারা আকারে বড় এবং ইতিমধ্যেই স্তন টিস্যুর বাইরে শরীরের অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। পরিব্যক্তির (জিনগত) ধরনের ওপর নির্ভর করে, তা সত্ত্বেও আরোগ্যের সম্ভাবনা আকার ও টিউমারটি কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে, তার ওপর নির্ভরশীল। তাই  জরুরি প্রয়োজনে প্রাথমিক অবস্থা রোগ নির্ণয়ে সম্ভব, যদি নারীরা এ ব্যাপারে সচেতন থাকেন এবং স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে নিয়মিত চেকআপ করেন।

বিজ্ঞানীরা একটি লক্ষ্যকে সঠিকভাবে আঘাত করার জন্য একটি ওষুধ তৈরি করতে পারেন, কিন্তু একটি টিউমার নিজেকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরনের এখনো অনাবিষ্কৃত জেনেটিক কৌশল প্রয়োগ করে। ক্যানসার সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য না হলেও এটিকে প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করা গেলে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত রাখা সম্ভব।

প্রতিরোধে করণীয় (ঝুঁকি কমানোর উপায়)

ক. অধিক পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম
খ. মানসিক স্বস্তি, সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত শারীরিক ওজন
গ. ২০-৩০ বছর বয়স থেকে নিজেই নিয়ম অনুযায়ী স্তন পরীক্ষা শুরু করা উচিত।
ঘ. ৩০ থেকে ৪৫ বছরোর্ধ্ব নারীদের ঝুঁকির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে বিধায় তাঁদের প্রতিবছর পরীক্ষা করানো উচিত এবং ম্যাসোগ্রাফি ও অন্যান্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।

হরমোন চিকিৎসা ও টার্গেটেড থেরাপি

নির্দিষ্ট ইস্ট্রোজেন প্রতিক্রিয়া পরিবর্তক দ্বারা পজিটিভ স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে রিসেপ্টর ব্লককারী হরমোনের কাজ বন্ধ করে দেয় এবং ফলস্বরূপ ইস্ট্রোজেন সিগন্যালিং পাথওয়েকেও বন্ধ করে দেয়।
নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট চিকিৎসায় (টার্গেটেড থেরাপি): নির্দিষ্ট চিকিৎসাগুলো নির্দিষ্ট কোনো প্রোটিনেরওপর কাজ করে। মনোকোনাল অ্যান্টিবডি প্রোটিনকে টিউমার বৃদ্ধি উদ্দীপিত করতে বাধা দিতে পারে। প্রচলিত কেমোথেরাপি অপেক্ষা নির্দিষ্ট থেরাপিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম।
কেমোথেরাপি: শুধু বড় আকারের চাকা যদি ধরা পড়ে, তাহলে এটি নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক পর্যায়ে স্টেজ এক বা দুইয়ের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ নেই। কেমো ও ইমিউনোথেরাপি দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায়।

কেমো প্রতিরোধ

এ দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে ওষুধের মাধ্যমে ক্যানসারের ঝুঁকির পরিমাণ কমানোর পদ্ধতি।  টামোক্সিফিন ও ক্যালেফসিকিন-এর ওষুৎগুলো আমেরিকার এফডিএ  অনুমোদিত, যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি প্রশমিত করে। যাঁদের পরিবারে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী বিদ্যমান ছিল বা রয়েছে, তাঁদের জজ্য প্রযোজ্য।  

ফলাফল

৫ থেকে ১৫ বছর পর্যায়ক্রমে ১৫ বছর বেঁচে থাকার হার স্তন টিস্যুতে সীমাবদ্ধ (স্টেজ এক ও দুই) ক্যানসারের ক্ষেত্রে ৯৯ শতাংশ এবং এলাকাভিত্তিক ছড়িয়ে পড়া, অর্থাৎ কাছাকাছি লসিকাগ্রন্থির নালিতে ছড়িয়ে পড়া টিউমারের (স্টেজ তিন) জন্য ৮৪ শতাংশ। স্টেজ চার এবং দূরবর্তী অর্গান সংক্রমণকৃত ক্যানসারে রোগীর আরোগ্য হয়ে ৫ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ২৩ শতাং।
দুঃখজনকভাবে সত্যি যে আমাদের দেশে প্রাথমিক অবস্থা নির্ণয়ের জন্য কোনো স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই বড় চাকা ও লক্ষণগুলো বা ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার পর নারীরা চিকিৎসার শরণাপন্ন হন।

  • অধ্যাপক ডা. তাসনিম আরা সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক,
    সেলিমা ইনস্টিটিউট ফর ক্যানসার ইমিউনোথেরাপি ও সেল থেরাপি
    [email protected]