এ সপ্তাহে সান দিয়াগোতে তিন দেশের মধ্যে পারমাণবিক সাবমেরিন বিষয়ে চুক্তি হলেও, অস্ট্রেলিয়া-চীনের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে জেনেও, এ সিদ্ধান্ত ক্যানবেরা অনেক আগেই নিয়েছিল।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম অকাস চুক্তি নিয়ে খবর প্রকাশ পায়। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকেই বেইজিং ক্যানবেরাকে নমনীয় বার্তা দিতে শুরু করে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি চীনের এ নমনীয় কূটনীতি অনেকটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই বছরের জুনের পর থেকে অস্ট্রেলিয়া ও চীনের মন্ত্রী ও নেতৃত্বপর্যায়ে একগুচ্ছ উষ্ণ বৈঠকের মধ্য দিয়ে সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।
অস্ট্রেলিয়া যে তাদের স্বার্থের ভিত্তিতেই অকাস চুক্তি করেছে, সেটা খুব ভালো করে জেনেই চীন সরকার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে অগ্রসর হয়েছে। চীন এখন অস্ট্রেলিয়ার জন্য তাদের বন্ধ করে দেওয়া বাজার আবার খুলে দিয়েছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে যদি অস্ট্রেলিয়া তাদের পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করে, তাহলে চীনের সামরিক লক্ষ্য অর্জন করা কঠিনতর হয়ে উঠবে। এখন পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার হবে কি না, সেই ভয় ছড়াবে চীন সরকার। একই সঙ্গে প্রশ্নাতীতভাবে এই দাবি ছড়াবে যে অস্ট্রেলিয়া এবং এর অকাস–সঙ্গীরা আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা রদ করে দিয়েছে।
কিন্তু সাবমেরিন চুক্তিকে কেন্দ্র করে বেইজিং ক্যানবেরার বিরুদ্ধে চোখ বন্ধ করে একগাদা অভিযোগ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের নিরাপত্তা ভূমিকা কমিয়ে আনতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।
এ ছাড়া বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তারা নিশ্চিত করতে চায় এবং চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্য অস্ট্রেলিয়ার বাজার ক্রমান্বয়ে সীমাবদ্ধ করে চলেছে। এগুলোর কোনোটিই কিংবা দুই পক্ষের বিতর্কিত অন্য বিষয়ও, দুই দেশের সম্পর্ক মেরামতের ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এসব বিষয়ে গভীর অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ‘সঠিক পথে ফেরাবে’।
উপরন্তু চীনের এ কঠোর অকাসবিরোধী বাগাড়ম্বরের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া সম্ভবত তাদের পারমাণবিক সাবমেরিন পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্কও বজায় রাখতে সক্ষম হবে। তবে এই নয় যে চীন তাদের অকাসবিরোধিতা
বন্ধ করে দেবে। কেননা, শুরু থেকেই চীন বিষয়টিকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখছে। অকাসের প্রতি চীনের এ বৈরিতায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে চীনের লক্ষ্য হচ্ছে, ধীরে ধীরে তাইওয়ান দখলে নিয়ে সামরিক দিকে শুধু আঞ্চলিক নয়, বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা।
পারমাণবিক সাবমেরিনের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া উত্তর–এশিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে পারবে। এর অর্থ এই নয় যে যদি তাইওয়ানকে রক্ষা করতে গিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত বেধে যায়, তখন অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে সমর্থন দেবে।
কিন্তু বেইজিং বুঝতে পারছে, নতুন এসব সাবমেরিনের কারণে তাইওয়ান প্রণালি ও পূর্ব চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক কর্মকাণ্ডে অস্ট্রেলিয়াকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা সরবরাহ করতে হবে।
এটা নিশ্চিত যে কোনো লড়াই ছাড়াই তাইওয়ানকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক আভ্রিল হাইনেস গত সপ্তাহে আইনসভার গোয়েন্দাবিষয়ক কমিটিকে বলেছেন, ‘চীন যুদ্ধে জড়াবে, সেটা আমাদের মূল্যায়ন নয়।’
কিন্তু বেইজিংয়ের লক্ষ্য হচ্ছে, এটা নিশ্চিত করা যে যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে তাইওয়ান প্রণালি এবং এর চারপাশে যেকোনো সংঘাতে জয়ী হওয়ার সক্ষমতা তাদের আছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে প্রচেষ্টা চলছে, তাতে যদি অস্ট্রেলিয়া তাদের পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করে, তাহলে চীনের সামরিক লক্ষ্য অর্জন করা কঠিনতর হয়ে উঠবে।
এখন পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার হবে কি না, সেই ভয় ছড়াবে চীন সরকার। একই সঙ্গে প্রশ্নাতীতভাবে এই দাবি ছড়াবে যে অস্ট্রেলিয়া এবং এর অকাস–সঙ্গীরা আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা রদ করে দিয়েছে।
সর্বোপরি, নানা উত্তেজনা ও টানাপোড়েন সত্ত্বেও চীন ও অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের যে প্রেক্ষাপট, তাতে করে পারমাণবিক সাবমেরিনের এ ঘোষণায় শেষ পর্যন্ত বেইজিং ক্যানেবেরার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ড. বেনজামিন হার্সকোভিচ রিসার্চ ফেলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া