এরদোয়ান-মোহ কাটছে তুর্কিদের

গত এক দশকে দেশটি নিঃসন্দেহে এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পিছিয়ে পড়েছে।ছবি : রয়টার্স

অনেক পর্যবেক্ষকের ভুরু কপালে তুলে গত রোববার তুরস্কের স্থানীয় ভোটে সরকারবিরোধীরা বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন।

ভোটের এই ফল নিশ্চিতভাবেই তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেবে।

ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, মধ্য-বামপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) সারা দেশে মোট ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এটি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং তাঁর ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) জন্য একটি বড় ধাক্কা।

এই নির্বাচনে একেপি পেয়েছে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখন তুরস্কের ৮১টি প্রদেশের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় ১০টি মহানগরসহ ৩৫টি প্রদেশই শাসন করবেন সিএইচপির মেয়ররা।

সিএইচপির নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব এলাকার মোট জনসংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লাখ। আর অন্যদিকে এরদোয়ানের একেপি জিতেছে ২৪টি প্রদেশে, যেগুলোর মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৯৫ লাখ।

সিএইচপির এই অবাক করা জয়ের পেছনে তুরস্কের চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

এরদোয়ানের অনুসৃত ভুল সামষ্টিক নীতি সাধারণ তুর্কি নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে, মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে এবং তুর্কি মুদ্রা লিরাকে ধাক্কা মেরে অনেক নিচে ফেলে দিয়েছে।

আর এসবেরই রাজনৈতিক পরিণতি ভোগ করছেন এরদোয়ান ও তাঁর একেপি।

তুরস্কের মহানগর এলাকাগুলোতে, যেখানে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের চেয়ে শ্রমিক শ্রেণি মূল্যস্ফীতির বড় শিকার হয়েছে, সেখানে এই অবস্থা বেশি দেখা গেছে। গভীর অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে মানুষের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা একেপির ভোট কমিয়ে দিয়েছে।

দেশটির বিরোধী রাজনীতিকদের সহজাত নেতা হিসেবে ইস্তাম্বুলের মেয়র ও সিএইচপির নেতা একরেম ইমামোগলুর উত্থানকে তুরস্কের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

একেপির প্রার্থী মুরাত কুরুমকে ১২ শতাংশ পয়েন্টের ব্যবধানে পেছনে ফেলে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে ইমামোগলু সহজেই পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও একটি চিত্তাকর্ষক দিক হলো তাঁর প্রতিপক্ষ কুরুমের প্রচারণায় খোদ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সম্পৃক্ততা, সংবাদমাধ্যমের ফলাও প্রচার এবং আনুষঙ্গিক সরকারি সুবিধা ছিল; কিন্তু তারপরও কুরুম হেরে গেছেন।

গতবারের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তৎকালীন সিএইচপি নেতা কেমাল কিলিচদারুগলুকে সমর্থন করে প্রায় সব কটি বিরোধী দল জোট গঠন করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে তারা ব্যর্থ হওয়ার পর, বিরোধী জোট ভেঙে পড়ে। গত রোববারের স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব প্রার্থী দেয়।

আসলে এটি ক্ষমতাসীন একেপির বিরুদ্ধে (এবং বলা যায় এরদোয়ানেরও বিরুদ্ধে) ইমামোগলুর তৃতীয় জয়।

ঠিক পাঁচ বছর আগে ইমামোগলু ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে জিতেছিলেন। ওই নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একেপি নেতা ও তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। ওই মেয়র নির্বাচনে ইমামোগলু ১৩ হাজার ভোটে ইলদিরিমকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু এরদোয়ানের সরকার ওই ভোটে ‘অনিয়ম’ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ভোটের বৈধতা বাতিল করে দেয় এবং প্রার্থীদের আবার নির্বাচনে নামতে বাধ্য করে। সে ভোটেও প্রায় ৮ লাখ ভোট পেয়ে ইমামোগলু জিতে যান।

এসব বিবেচনায় নিয়ে গত রোববারের ইমামোগলুর জয়কে ২০১৯ সালের স্থানীয় নির্বাচনের শেষ রাউন্ড এবং ২০২৮ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের আলোকে ব্যাখ্যা করা উচিত।

এই নির্বাচনের ফল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৮ সালের পরও এরদোয়ান যাতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন সে জন্য ক্ষমতাসীন একেপি দ্বিতীয়বারের মতো সংবিধান সংশোধনে উদ্যোগী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই ভোটের ফল একেপির সেই পদক্ষেপের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

একেপির রাজনৈতিক জেল্লা এই নির্বাচনী ফলের কারণে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে। এটি এরদোয়ানের অজনপ্রিয়তাকে তুলে ধরছে। ফলে একেপির রাজনৈতিক মর্যাদার ম্লান হয়ে যাওয়া চেহারা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এরদোয়ানের ক্ষমতা প্রলম্বিত করার উদ্যোগের বৈধতাকে ইতিমধ্যেই ক্ষুণ্ন করেছে।

যেহেতু এখন সংবিধান পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই এরদোয়ানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি দিনকে দিন জোরালো হতে থাকবে।

এখন প্রশ্ন হলো এরদোয়ানের এই মেয়াদই যদি সত্যি সত্যি তার শেষ মেয়াদ হয়, তাহলে তাঁর সেই শূন্যস্থান কে বা কারা পূরণ করবেন?

বছরের পর বছর ধরে তুরস্ক যে অর্থনৈতিক সমন্বয় কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে, একেপির এই বড় পরাজয় সেই কর্মসূচির ভবিষ্যতের ওপরও ছায়া ফেলেছে।

২০২৩ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর অর্থনৈতিক গোঁড়ামিতে ফিরে আসাকে দলটির এই নির্বাচনের বিপর্যয়ের জন্য অনেক একেপি সদস্য দায়ী করবেন।

সুদের হার মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ানো এবং রক্ষণশীল রাজস্ব নীতি অনুসরণের কারণে তুরস্কে যে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই একেপির জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে।

কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই তেতো বড়ি অপরিহার্য থেকে যাচ্ছে এবং কমপক্ষে আরও ১২ থেকে ১৮ মাসের জন্য এই নীতি অনুসরণ করতে হবে। তত দিন একেপিকে এই যন্ত্রণাদায়ক সমন্বয়ের জন্য দলের অভ্যন্তরীণ নেতাদের রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করতে হবে।

গতবারের প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তৎকালীন সিএইচপি নেতা কেমাল কিলিচদারুগলুকে সমর্থন করে প্রায় সব কটি বিরোধী দল জোট গঠন করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে তারা ব্যর্থ হওয়ার পর, বিরোধী জোট ভেঙে পড়ে। গত রোববারের স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব প্রার্থী দেয়।

বিরোধী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে এসব বিরোধী দল আলাদাভাবে বেশ ভালো ফল করেছে।

ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইমামোগলু এবং রাজধানী আঙ্কারার হবু সিএইচপি মেয়র মনসুর ইয়াভাস তাঁদের দলের সমর্থকদের বাইরের ভোটে টানতে সক্ষম হয়েছেন।

এই পরিস্থিতি বিরোধী দলগুলোর জন্য, বিশেষ করে ইমামোগলু এবং সিএইচপির চেয়ারম্যান ওজগার ওজেলের জন্য ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বকে স্বস্তিদায়ক করেছে।

শেষ পর্যন্ত গত রোববারের নির্বাচনে সম্ভবত তুর্কি গণতন্ত্রেরই প্রকৃত জয় হয়েছে।
তুর্কি ভোটাররা আবারও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ দেখিয়েছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সম্ভাবনার প্রতি তাঁদের আস্থা প্রদর্শন করেছেন।

গত এক দশকে দেশটি নিঃসন্দেহে এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পিছিয়ে পড়েছে।

কিন্তু তুর্কিরা দেখিয়ে দিয়েছেন তুর্কি প্রজাতন্ত্র দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রবেশকালে কেন শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিশ্বের ঘাটে দৃঢ়ভাবে নোঙর ফেলেছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
সিনান উলগেন একজন সাবেক তুর্কি কূটনীতিক, যিনি বর্তমানে ইস্তাম্বুলভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক  ইডামের পরিচালক এবং কার্নেগি ইউরোপের একজন সিনিয়র পলিসি ফেলো।