নতুন বছর এবং বিশ্ববাসীর কিছু পুরোনো প্রত্যাশা

পুরোনো গাছে নতুন পাতা, সঙ্গে সূর্যের আবরণ! কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর সাদুবাজার থেকে তোলাছবি: সোহানুর রহমান সোহাগ

সময়ের স্বাভাবিক গতিধারায় বিশ্ব হতে বিদায় নিল ২০২৩। করোনা মহামারি ও করোনা মহামারির মধ্যেই ইউরোপের বুকে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বছরব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের ঘনঘটা ও তার ফলে সৃষ্ট প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত বিপর্যয় মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ, আফ্রিকা ভূখণ্ডে সামরিক অভ্যুত্থানের হিড়িকে অবনমিত বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বছরের শেষ দিকে প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত থাকা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশ্বের মানুষের মনে নতুন বছরে কিছু পুরোনো প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে নতুন করে।

প্রথমেই বিবেচনায় আনা যাক করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অপর্যাপ্ত সরবরাহ বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি করে তার ফলে করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ৪০ শতাংশে। যা ছিল বিগত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আওতাধীন সকল দেশে ঘটে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি—যা একটি মন্দার পর না ঘটাই অস্বাভাবিক।

তবে এই মন্দার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় করোনা মহামারি সমাপ্তির প্রাক্কালে ভূরাজনৈতিক কারণে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই বিশ্ব অর্থনীতির বিশেষত বিশ্ব জ্বালানি বাজারের এক প্রভাবশালী অংশ। পাশাপাশি শস্য রপ্তানির শীর্ষ ২০টি দেশেরও অন্তর্ভুক্ত দেশ দুটি। ফলে করোনা মহামারির মধ্যেই তাদের এ ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি করে। ইউরোপ মুখোমুখি হয় ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির। অথচ ২০২৩ সালজুড়ে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা ছিল করোনার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার।

২০২৩ সালে বিশ্ব সাক্ষী হয় বেশ কয়েকটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের। ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের গাজিয়ানতেপে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় অর্ধ লাখেরও বেশি মানুষ। ভেঙে পড়ে দেশটির এক বৃহৎ অংশের আবাসন ব্যবস্থা। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর মরক্কোর মারাকেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে আটলাস পর্বতমালার ইঘিল শহরের কাছে ৬.৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতেও বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ধসে ২৯৪৬ জনের মৃত্যু হয়।

এর এক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানের হেরাতে ৬.৩ মাত্রার জোড়া ভূমিকম্পে নিহত হন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। পাশাপাশি বছরজুড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কয়েকশ প্রাণহানি ও হাজার হাজার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যা নতুন বছরে বিশ্বের বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের মনে পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে নিরাপদ ও ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রত্যাশাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে নতুন করে।

আফ্রিকা ভূখণ্ডে ২০২৩ সালজুড়ে অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থান দেখা যায়। বছরের মধ্য আফ্রিকা ও সাব-সাহারান অঞ্চলের পাঁচটি দেশ: নাইজার, সিয়েরালিওন, গ্যাবন, বুরকিনা ফাসো ও গিনি বিসাওতে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এ ছাড়াও এ বছরেই সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্বে সুদানে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যাতে প্রায় অর্ধ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে এক বছরে এতগুলো সামরিক অভ্যুত্থান বেশ আলোচনা তৈরি করে বিশ্বজুড়ে।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো একই বছরে একটি মহাদেশের এতগুলো দেশে সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধস নামার পরও দেশগুলোর সাধারণ মানুষেরা সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিয়ে উল্লাস করেছে। কারণ তারা দেশের গণতন্ত্রমনা ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থ উদ্ধারকারী নেতৃবৃন্দের চেয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রতি যত্নশীল লোকদের প্রতি অধিক আস্থা রাখতে ইচ্ছুক।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা হতে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালায়। যার প্রেক্ষিত শুরু হয় গাজায় ইসরায়েল অভিযান শুরু করে। অঞ্চলটিতে দেখা দেয় ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় সংঘাত। এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর আরও সশস্ত্র গোষ্ঠী জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু করোনা মহামারি ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পর এ ধরনের যুদ্ধ কোনোভাবেই কামনা করে না বিশ্ববাসী। এখন পর্যন্ত গাজা যুদ্ধে ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে, যার বেশির ভাগই ফিলিস্তিনি। গাজার ফিলিস্তিনিরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অঞ্চলটিতে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় রুখতে অবিলম্বে এ যুদ্ধ বন্ধ হোক—এটাই নতুন বছরে সারা বিশ্বের প্রকৃত মানবতাবাদীদের অন্তরের পুরোনো প্রত্যাশা।

রুশাইদ আহমেদ
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়