দেওয়ানি কার্যবিধির সংশোধন: বিচারব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা

আমাদের সমাজে মানুষ যেসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তার অধিকাংশের মূলে রয়েছে সম্পত্তি–সংক্রান্ত বিরোধ। বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলার উৎপত্তি হয়ে থাকে দেওয়ানি মামলাকে কেন্দ্র করে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সম্পত্তি–সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে সমাজের অনেক বিরোধ কমে যাবে।

জমিজমা–সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেওয়ানি কার্যবিধি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। দেশে বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধি আইনটি শত বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে প্রণীত এই আইন বাংলাদেশের দেওয়ানি মামলার মূল আইন এবং একই সঙ্গে পদ্ধতিগত আইন হিসেবেও বিবেচিত হয়। দেওয়ানি কার্যবিধি প্রণীত হয়েছিল ১৯০৮ সালে। সেই হিসাবে এই আইনটির বয়স ১১৬ বছর।

১১৬ বছরে সমাজসভ্যতা ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হলেও সময়ের প্রেক্ষাপট ও চাহিদার নিরিখে এই আইনটি সেই মাপে উন্নীত করা হয়নি। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে; কিন্তু জনহয়রানি রোধ ও দ্রুত মোকদ্দমা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংশোধনীগুলো খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালত মিলে দেওয়ানি মামলার পাহাড় জমে উঠেছে।

পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলা ছিল ১৯ হাজার ২৯১টি। একই সময়ে হাইকোর্টে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ছিল ৯৮ হাজার ৬১৯টি। অধস্তন আদালতে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭টি।

বছরের পর বছর ধরে চলমান এসব মামলা-মোকদ্দমায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় বাধা। আমি দেড় দশকের অধিক সময়ের বিচারক জীবনে এমন কিছু দেওয়ানি মামলা পেয়েছি, যা দায়ের হয়েছে আমার জন্মেরও আগে। জমি নিয়ে দাদার দায়ের করা মামলা নাতির আমলে এসে নিষ্পত্তি হয়েছে, এমন মামলাও পেয়েছি। এগুলো বিচ্ছিন্ন দু–একটি ঘটনা নয়, আমার মনে হয়, প্রত্যেক বিচারকের এ রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দেওয়ানি মামলা বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং সময় ক্ষেপণের মূলে শত বছরের এই পুরোনো আইনটিকে তাই দূষছেন অনেকে। পুরোনো এই আইন বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন এই আইন সংস্কার করা খুব প্রয়োজন ছিল। এসব দিক বিবেচনা করে দেওয়ানি বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করার উদ্দেশে ২০২৫ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

দেওয়ানি মামলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সমনজারি নিয়ে। বিদ্যমান আইনে বিবাদীর প্রতি সমন জারি করা হতো আদালতের পেয়াদা বা জারিকারকের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে সমনের কপি ডাকযোগেও পাঠানো হতো বিবাদীর ঠিকানায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কখনো এই সমন ফেরত আসতে বছরের বেশি লেগে যায়।

দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল সময়ের আবেদন। আগের আইনে ছয়বার পর্যন্ত মুলতবি চাওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে অসংখ্যবার নানা অজুহাতে পক্ষদের সময় নিতে দেখেছি। এ সংশোধনীর ফলে মামলা বিলম্বিত করতে সময়ের আবেদন করার সুযোগ কমছে। এক কথায় সময়ের আবেদনের গলায় ঘণ্ট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী এখন চারবারের বেশি সময় চাওয়া যাবে না। এতে মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে ।

দীর্ঘ সময় পরও সমন ফেরত না আসার বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, উপদেশ নসিহত হয়েছে বিস্তর। তার পরও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। নতুন সংশোধনীর ফলে সমন জারি করার পদ্ধতিতে যুক্ত হয়েছে মুঠোফোন, এসএমএস, ভয়েস কল ও ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সার্ভিস। এ ছাড়া মামলা করার সময় মুঠোফোন নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং ই–মেইল (যদি থাকে) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আগে মোকদ্দমার বাদী ও বিবাদী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে পুরো আর্জির বর্ণনা দিত মৌখিক সাক্ষ্যে। বিচারককে তা লিখতে হতো পাতার পর পাতা। কখনো কখনো বড় বাটোয়ারা মামলায় বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতেই বিচারকের লেগে যেত দু–তিন দিন। এভাবে বিবাদীর জবাবও পুরোটাই সাক্ষ্য আকারে লিখতে হতো।

যে কথাগুলো আরজি ও জবাবে লেখা আছে, সেই একই কথা পুনরায় বিচারককে দিয়ে লেখানোতে আদালতের ব্যয় হতো অনেক সময়। এই ঝামেলা আর থাকছে না, এখন মামলার বাদী বিবাদীকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দী দিতে হবে না। লিখিত জবানবন্দী আদালতে জমা দিতে হবে হলফনামা আকারে। এতে বেঁচে যাবে অনেক সময়।

অর্থ আদায়ের মামলায় রায় প্রাপ্তির পর জারি মামলা নামে পৃথক একটি মামলা করতে হতো। এখন থেকে আর জারি মামলা করতে হবে না। মূল মামলাতেই জারি–সংক্রান্ত দরখাস্ত দাখিল করে অর্থ আদায় করা যাবে। এ ছাড়া এ–সংক্রান্ত মামলায় দেওয়ানি আদালত ডিক্রিহোল্ডারের আবেদন মোতাবেক বিবাদীকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি আটকাদেশ দিতে পারবে।

এককথায় আগে আদালতের রায় ও ডিক্রি কার্যকর করতে পৃথক মামলা করতে হতো। এখন আর্থিক ডিক্রিসহ কিছু ডিক্রি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।

দেওয়ানি আদালতে যেসব মামলা করা হয়, তার অধিকাংশ হলো ঘোষণামূলক মামলা। বিদ্যমান আইনে আদালত শুধু ব্যক্তির বৈধ অধিকার বা স্বত্ব ঘোষণা করে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো নির্দেশ দেয় না। এখন থেকে দেওয়ানি আদালত রায় ও আদেশ কার্যকর করতে পুলিশসহ যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিতে পারবে। এই সুযোগ আগে ছিল না।

কোনো ব্যক্তি আদালতের রায়, আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ভায়োলেশন মামলায় আদালত তাকে আটক করার নির্দেশ দিতে পারে। এ ধরনের মামলায় ইতিপূর্বে বিবাদীকে জেলখানায় আটক রাখার খরচ বাদীকে বহন করতে হতো। ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলেও খরচ বহনের ভয়ে ভায়োলেন্স মামলা করতেন না অনেকেই। নতুন এ সংশোধনীতে বিবাদীকে জেলখানায় থাকার খরচ সরকার বহন করবে। ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার প্রবণতা কমে যাবে আশা করা যায়।

আপিল দায়েরের পর আপিলকারী বা প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতির কারণে আপিল মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হতো। এখন শুনানির তারিখে পক্ষদ্বয় উপস্থিত না থাকলেও আদালত রায় ঘোষণা করতে পারবেন। এভাবে আপিল মামলা বিলম্বের সুযোগ কমে যাবে।

দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল সময়ের আবেদন। আগের আইনে ছয়বার পর্যন্ত মুলতবি চাওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে অসংখ্যবার নানা অজুহাতে পক্ষদের সময় নিতে দেখেছি। এ সংশোধনীর ফলে মামলা বিলম্বিত করতে সময়ের আবেদন করার সুযোগ কমছে। এক কথায় সময়ের আবেদনের গলায় ঘণ্ট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী এখন চারবারের বেশি সময় চাওয়া যাবে না। এতে মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে ।

মামলা শুনানির সময় বিবাদীর অনুপস্থিতির কারণে আদালত বাদীপক্ষে একতরফা রায় দেয়। আগের আইনে বিবাদী নানা অজুহাতে একতরফা রায় বাতিল করতে একাধিকবার আবেদন করতে পারত। এটা ছিল একপ্রকার সাপলুডুর মতো খেলা। এখন থেকে বিবাদী একবারের বেশি এ ধরনের আবেদন আর করতে পারবে না।

দেওয়ানি আদালতে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করলে জরিমানা হতে পারে। বিবাদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক হলে, আদালত মামলা দায়েরকারী ব্যক্তিকে জরিমানা করতে পারেন। মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলার জন্য সর্বোচ্চ জরিমানা ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে আশা করা যায়, হয়রানিমূলক মামলা অনেকাংশে কমে যাবে।

এককথায় দেওয়ানি মামলা বিচারে বছরের পর বছর সময় ক্ষেপনের যেসব আইনি কারণ ছিল, এই সংশোধনীতে সেগুলোকে যথাসম্ভব দূর করা হয়েছে। তাই যুগের পর যুগ ধরে বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়ায় দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫, বিচারপ্রার্থীদের জন্য ম্যাগনাকার্টা হয়ে থাকবে। এই অধ্যাদেশের ফলে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্তি পাবেন এবং আদালতের মামলার জট কমবে বলে আশা করা যায়।

মতিউর রহমান, বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।

মতামত লেখকের নিজস্ব