হুমায়ূন আহমেদের ‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এর পথে যেতে যেতে

হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি বিজড়িত ‘হোটেল গ্রেভার ইন’
ছবি: তাসফিয়া তাবাসসুম

আমেরিকায় পড়তে আসার পর থেকেই ভাবতাম, হ‌ুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির শহর ফার্গোতে সুযোগ পেলেই বেড়াতে যাব। এ গ্রীষ্মে সেই সুযোগ হলো। বিশাল বড় কয়েকটি অঙ্গরাজ্য পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলাম নর্থ ডাকোটায়। মাঝে আরও কত পাহাড়, নদী, সমতল, গিরি আর স্মৃতি!

মোটামুটি তিন হাজার মাইলের একটা ভ্রমণ। মাইল, কিলোমিটার নয়। এদের সব পরিমাপের একক আমাদের চেয়ে ভিন্ন। যেমন আমরা মাপি কেজিতে আর তারা মাপে পাউন্ডে। আমরা যাই বাঁ দিক দিয়ে আর এরা ডান দিক দিয়ে। প্রায় পাঁচটা অঙ্গরাজ্যের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেখতে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় পাঁচ-ছয় দিনের।

এর মধ্যে অবশ্য সাউথ ডাকোটা আর নেব্রাস্কায় শুধু ঘুরে দেখা হয়েছে, রাতে থাকা হয়নি। আসলেই নানা অভিজ্ঞতা হয় ঘুরে বেড়ালে, অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখা যায়।

মানুষের নানা রূপ দেখা যায় প্রকৃতির নানা রকম রূপের পাশাপাশি। অনেক ভুল ভাঙে, হয়তো আবার নতুন নতুন ভুলও যুক্ত হয়। যেমন আমাদের মতো গরিব দেশ থেকে যাঁরা আসি এখানে, তাঁদের অনেকের মতো আমিও ভাবতাম, আমেরিকা তো অনেক ধনী দেশ। সেখানে বুঝি গরিব মানুষ নেই।

নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। এখানেই হুমায়ূন আহমেদ পিএইচডি গবেষণা করেছিলেন।
ছবি: তাসফিয়া তাবাসসুম

এটি ঠিক, আমেরিকা ধনী দেশ, কিন্তু গরিব মানুষেরও এখানে অভাব নেই। কবি আবুল হাসানের কবিতার লাইনের মতোই সারা পৃথিবীর ক্ষুধার ভাষা আসলে একই।
মন্টানার এক দোকানের পাশে হুইলচেয়ারের ওপর বসে এতটা অসহায়ভাবে আমার কাছে এক লোক ভিক্ষা চেয়েছিল, যে অসহায়ত্ব আমি বাংলাদেশেও দেখিনি।

এখানে আমি যে শহরে থাকি, তা মোটামুটি ছিমছাম ছোট শহর হলেও অনেককেই প্ল্যাকার্ড নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখি। কিন্তু কখনো ডলার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বা মায়ার উদ্রেক হয়নি। তবে মন্টানার ওই লোকের চেহারা এখনো মনে পড়ছে। বাধ্য হয়েছি এক ডলার দিতে। এত গরিব মানুষ এই আমেরিকাতেও থাকে! বুঝতে পারলাম, কত সম্পত্তি আছে, এটা আসলেই ব্যাপার নয়, সম্পদের বণ্টন কীভাবে হলো, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

এ ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো, আমরা যারা বিদেশে থাকি, তারা শুধু এখানকার ভালো দিকগুলো নিয়েই লিখি। খারাপ ব্যাপারটা কেউ বলতে বা লিখতে চাই না। কোনোভাবে আমরা কেউই এটা প্রকাশ করতে চাই না যে আমি একটু খারাপ আছি অথবা সময়টা একটু খারাপ যাচ্ছে। সেই একই কারণে আমরা ফেসবুকে শুধু নিজের ভালো থাকার গল্পগুলোই প্রচার করি। পরে আবার অন্যের তথাকথিত ভালো থাকার প্রচারণা দেখে, তার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে কষ্ট পাই। কিন্তু আসলে সবারই ভালো-মন্দ থাকে।

নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের ক্যাম্পাস। হুমায়ূন আহমেদ এখানেই পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি গবেষণা করেছিলেন।
ছবি : তাসফিয়া তাবাসসুম

এখন আমেরিকায় সামার। শীতপ্রধান অঞ্চলে সাত-আট মাস বরফের নিচে থাকার পর সামার এলে মানুষ অন্য রকম হয়ে যায়। স্কুল-কলেজ কেন সব বন্ধ হয়ে যায়, দ্বিতীয় সামার আসার পর আমিও টের পেলাম। দিন অনেক বড় হয়ে যায় এ সময়, সূর্যের তাপও বেড়ে যায় অনেক। মনটাও চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাই আমরা ভোরে উঠেই রওনা দিয়েছিলাম মন্টানার উদ্দেশে।

মাঝে পুরো ওয়াইওমিং রাজ্যটা পাড়ি দিতে হয়েছে। কলোরাডো আর ওয়াইওমিংয়ের ভূপ্রকৃতি অনেকটা কাছাকাছি। পাহাড়ি। তবে মন্টানার কাছাকাছি আসতেই সমতল ভূমির আবেগ পেয়ে বসল।

আহা! অনেক কিছুই নিজের দেশের মতো মনে হয়। ওই তো একটা জংলা, যার পাশে কিছু ছোট গাছ, গুল্ম, ঘাস। তারও ওই পাশেই ছোট নদীর মতো হয়ে গেছে। কী সুন্দর, নিবিড়। এসব নদ-জল-জোনাকির পাশেই তো হোগলার বন, যা নিয়ে আমাদের কবি জীবনানন্দ কবিতা লিখেছেন।

সত্যি আমাদের দেশের মতো কি না দেখার জন্য গাড়ি একপাশে পার্ক করে নেমে পড়লাম। হুম, অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। অনেক দূরে পাহাড় দেখা গেলেও কাছের জমিগুলো সমান, সমতল। কেউ এসে হাল দিয়ে গেছে ফসল বোনার জন্য।

কিন্তু যা কোনোভাবেই আমাদের দেশের মতো নয়, তা হলো, কোথাও কোনো মানুষ নেই। আমাদের দেশে আছে মানুষ। চারদিকে মানুষ। মানুষ ছাড়া মানুষ বাঁচে না। আর এখানে সবকিছু বিরান। প্রান্তরের পর প্রান্তর জমি প্রস্তুত করা হয়েছে এই গরমের কয়েক দিন চাষাবাদ করার জন্য। কিন্তু কোথাও কেউ নেই!

আমাদের দেশের এ রকম জমিগুলো টুকরা হতে হতে, জমির ভেতর দিয়ে আল উঠতে উঠতে, ভাগাভাগি হতে হতে সবকিছু কত সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমরা কাটব্যাংক শহরের কাছাকাছি চলে এলাম। এখানে রাতে হোটেলে ঘুমিয়ে পরদিন আমরা যাব গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক দেখতে।

পথে অবশ্য আমরা দুপুরের খাবারের জন্য মন্টানার সবচেয়ে বড় শহর বিলিংসে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছু কেনাকাটাও করা গেল। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, মন্টানা স্টেটে কেনাকাটার জন্য কোনো ট্যাক্স/ভ্যাট দিতে হলো না আমাদের। পরে জানতে পারলাম, হয়তো মানুষজন কম বলেই এ স্টেটে এসবের ঝামেলা নেই।

গ্লেশিয়ার পার্ক
ছবি সরবরাহ: লেখক

কাটব্যাংকের হোটেলটা সুন্দর। পাশেই একটা রেললাইন হোটেলের পেছনে একটা নদীর ওপর দিয়ে চলে গেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে। আমরা আমেরিকার শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। একটু পরেই কানাডার বর্ডার। ওপারে আর একটা দেশ আর একটা স্বপ্ন! গাড়ি চালিয়ে আমরাও গিয়েছিলাম ওই বর্ডারে।

একদম শান্ত। আমাদের দেশের মতো এত সীমান্তরক্ষী নেই। গাড়ি নিয়েই এপাশ-ওপাশ করা যাচ্ছে। কানাডার ওপারে হয়তো ক্যাসিনো অনুমোদিত নয়। এপারে অনুমোদিত, তাই ক্যাসিনোর দোকানের সামনে লেখা দেখলাম—‘ওয়েলকাম কানাডিয়ান’।
এতটাই বন্ধুত্ব দুই দেশের! আর ভারত উপমহাদেশে কী অবস্থা!

এদের রেললাইনে খুব একটা ট্রেন চলে না। যাত্রীবাহী ট্রেন এদের নেই বললেই চলে। সবারই একটা করে গাড়ি, কারও কারও দু–তিনটা। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপের দেশ। সবকিছুই ব্যবসা। করপোরেটদের হাতে সব পুঁজি জমা। সাধারণ মানুষ সেই সব পুঁজিপতিদের হাতে বন্দী। ভালো না লাগলেও আপনার এখানে গাড়ি কিনতে হবে।

বিনিময়ে ইন্টারস্টেট হাইওয়ে পাবেন নিরবচ্ছিন্ন। গাড়ি চালান, তেল ফুরান, ওজোন স্তর শেষ করে ফেলেন, কোনো সমস্যা নেই। টাকা খরচ করলেই হয়েছে। টাকা না থাকলে, ক্রেডিট কার্ডে ধার করবেন, তবু খরচ করবেন! এটাই আমেরিকা।

বিশাল বড় দেশ এই যুক্তরাষ্ট্র। অনেকগুলো রাজ্যই সেই ১৭৮৩ সালের পর থেকে একে একে যুক্ত হয়েছে এ রাষ্ট্রে। যেমন মন্টানা স্টেট যুক্ত হয়েছে ১৮৮৯ সালে। বেশ বড় রাজ্যই বলা চলে একে। আমেরিকার সব কটি রাজ্যের মধ্যে আয়তনে চতুর্থ, যদিও জনসংখ্যায় প্রায় তলানির দিকে হবে।

তো এসব রাজ্যের প্রায় প্রতিটিতেই কেন্দ্রীয় সরকার এই সব ন্যাশনাল পার্ক বানিয়ে রেখেছে লোকজনের ঘুরে বেড়ানোর জন্য। পার্ক বললে একটু ছোট ছোট শোনায়। আসলে এক একটা পার্ক এত বড় যে পুরোটা দেখতে, প্রতিটি স্পটে যেতে যে কত সময় লাগবে, তা আমি বলতে পারব না।

আমরা শুধু এক দিনের জন্য যাই, পা দিয়ে দু–একটা ছবি তুলে চলে আসি। এর বাইরে পুরোটা গাড়িতে ঘুরে দেখাও প্রায় অসম্ভব এক দিনে। তবে এবার প্রায় ১ দশমিক ৮ মাইল ট্রেইল করে একটা ঝরনার কাছাকাছি গিয়েছিলাম।

সত্যিই ভয়ংকর সুন্দর। শীতের সময় জমে থাকা তুষার এ গরমে গলে গলে ছোট ছোট ক্রিক হয়ে অবশেষে এ ঝরনায় এসে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
পরের দিন ভোরে আমরা রওনা দিলাম নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরের উদ্দেশে।

হুুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত ফার্গো শহর, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি। আমার শহীদুল্লাহ হলের রুমমেট প্রিয় ছোট ভাই দেলোয়ার ওই ইউনিভার্সিটিতেই এখন পড়ালেখা করছে। দেলোয়ার আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রায় সন্ধ্যায় গিয়ে পৌঁছালাম ফার্গোতে। অনেকটা নিরিবিলি শহর মনে হলো, যদিও এটাই নর্থ ডাকোটার সবচেয়ে বড় শহর।

তবে হ‌ুমায়ূন আহমেদের বর্ণনা দেওয়া সেই ‘বিফ অ্যান্ড বান’ অবশ্য আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এখন এটির মালিকানা সম্ভবত স্টেট গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে। এখন এখানে সিনিয়র সিটিজেনদের বাস। ছবি তুলতে খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। আশপাশে দু-একজন তাকিয়ে দেখলেন আমাদের।

প্রথমেই গেলাম নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। দেলোয়ার আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল বিভিন্ন ভবন। হ‌ুমায়ূন আহমেদ যে ভবনে গবেষণা করতেন, সেই ‘ডানবার হল’ গত বছর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ‘মেমোরিয়াল ইউনিয়ন’ অনেকবার এসেছে তাঁর স্মৃতির কথায়।

এরপর গেলাম সেই বিখ্যাত ‘হোটেল গ্রেভার ইন’-এ। এ হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেই স্মৃতিকথামূলক বইয়ের নামটিও এ হোটেলেরই নামে। হোটেলটিতে তিনি প্রথমবার এসে কিছুদিন ছিলেন।

তখন হোটেলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এক অতি ধনবান ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর সময় হোটেলটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গিয়েছিলেন।
এখানেও আমাদের ধনী আর এদের ধনীর মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়। তার পাশেই ছিল ‘বিফ অ্যান্ড বান’ হোটেল, যেখানে হ‌ুমায়ূন আহমেদ টাকাপয়সার টানাটানির কারণে টানা সাত দিন একই সস্তা বাটার টোস্ট খেয়েছিলেন। সেটি লক্ষ করে ‘বিফ অ্যান্ড বাটার’ কর্তৃপক্ষ একদিন তাঁকে বিনা মূল্যে অনেক পদের দামি খাবার খাইয়েছিল।

তবে হ‌ুমায়ূন আহমেদের বর্ণনা দেওয়া সেই ‘বিফ অ্যান্ড বান’ অবশ্য আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এখন এটির মালিকানা সম্ভবত স্টেট গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে। এখন এখানে সিনিয়র সিটিজেনদের বাস। ছবি তুলতে খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। আশপাশে দু-একজন তাকিয়ে দেখলেন আমাদের।

তাঁরা হয়তো ভাবছিলেন, এই সাদামাটা বিল্ডিংটির ছবি এই বিদেশিরা কেন তুলছেন?
যাহোক, যখন এ শহরের ভেতর দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, ফ্যামিলি হাউজিংয়ের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন সত্যি কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন জানি একটা অনুভূতি হচ্ছিল। আজ থেকে কয়েক দশক আগে আমাদেরই একজন লেখক এখানে থেকেছেন, এসব স্মৃতিমায়া তৈরি করেছেন।

কত ভালোবাসা নিয়ে তিনি সেসব স্মৃতি আবার লিখেও গেছেন। তাঁর সেসব স্মৃতির সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে। অথচ তিনি নেই!

  • মুশফিক নবীন, পিএইচডি গবেষক, কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং সহকারী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।