প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর কত দূর

২০০৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার ভ্রমণ নির্দেশিকায় আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির নাম দেখে বেশ উত্সাহী হয়ে উঠি। তাৎক্ষণিকভাবে মনে মনে একটা হিসাবও কষে ফেলি। আমাদের প্রাকৃতিক ইতিহাস বনাম যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক ইতিহাস—কোনটা বেশি সমৃদ্ধ? এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাদুঘরটি ঘুরে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের মিশেলে তৈরি সুবিশাল পরিসরের এ জাদুঘরে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ও স্থান পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সংগ্রহের বৈচিত্র্য এবং ব্যাপ্তির কারণে এটি বৈশ্বিক জাদুঘরেও পরিণত হয়েছে। কারণ, এই জাদুঘরের সংগ্রহ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিও ছুঁয়েছে। তা ছাড়া উচ্চতর গবেষণা, শিক্ষা কার্যক্রম, বর্ষব্যাপী প্রদর্শনীসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড এ জাদুঘরকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইনস্টিটিউটের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।
ফেরার পথে বারবার মনে হয়েছিল, আমাদের দেশে কেন এমন একটি জাদুঘর নেই। যে দেশের প্রকৃতি বিচিত্র সম্পদে ভরপুর, যেখানে পাহাড়, সাগর, নদী, হাওর আর অরণ্য মিলিয়ে সুবিশাল প্রাণিবৈচিত্র্যের সমারোহ, সেখানে এমন একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর তৈরির কথা কি কেউ ভাবেননি? দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল দেশে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু ঘোষণার পর দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, জাদুঘরের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনাসংবলিত নথিপত্র দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও জাতীয় জাদুঘরে সীমিত পরিসরে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু তা শুধু সূচনাপর্ব। এভাবে তো আর বছরের পর বছর চলতে পারে না।
অচিরেই প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে, এমন আশাবাদের সঙ্গে নিজস্ব কিছু ভাবনা যুক্ত করতে চাই। প্রথমত, এমন একটি বিশেষায়িত জাদুঘরের জন্য বড় ধরনের পরিসর প্রয়োজন। কারণ, একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্তত এক শ বা দুই শ বছরের কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। প্রতিনিয়তই এর সংগ্রহ বাড়বে। তখন স্থানাভাবে যেন নিয়মিত সংযুক্তির কাজ বন্ধ হয়ে না যায়। দেশের প্রাকৃতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নিয়ে কাজ করেছেন, এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। দেশের ঋতুবৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিয়ে আলাদা একটি গ্যালারি হতে পারে। কারণ, ঋতুবৈচিত্র্য এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। দেশের হারিয়ে যাওয়া জীবজন্তু, পাখি, পতঙ্গ, শাকসবজি, ফলমূল, বৃক্ষ, শৈবাল, শস্যসহ যাবতীয় প্রাকৃতিক উপাদানের নমুনাগুলো উপস্থাপন করা অত্যাবশ্যকীয়। যেসব প্রাণী ও বৃক্ষ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে মনে করা হয়, সেসব প্রাকৃতিক উপাদানের নমুনা অবশ্যই এ জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকা প্রয়োজন।
শুধু আমের বিশেষ জাতগুলোর নমুনা নিয়ে একটি বিশেষায়িত গ্যালারি থাকতে পারে। বিলুপ্ত বা বিপন্ন জাতের ধান নিয়েও একইভাবে প্রদর্শনী থাকতে পারে। সুন্দরবন, বলধা গার্ডেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানগুলোর একটি মডেলও উপস্থাপিত হতে পারে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদী, নদীকেন্দ্রিক যাপিত জীবন, জীববৈচিত্র্যসহ সব নদীর তথ্য ও মানচিত্র এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে। উপকূলবর্তী প্রায় ১৪টি জেলা ও দ্বীপকে জড়িয়ে রাখা বঙ্গোপসাগরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো জাদুঘরের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে।
এই জাদুঘরকে আমরা নিছক একটি কাঠামো হিসেবে দেখতে চাই না। এখানে আধুনিক মানের গবেষণা, গ্রন্থাগার ও উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দিবস ঘিরে নানামুখী কর্মসূচির প্রবর্তন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রাকৃতিক ইতিহাসনির্ভর বিভিন্ন ইভেন্টও থাকতে পারে।
সর্বোপরি একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা দরকার, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার মধ্যে সংযোগ তৈরি করবে। কাজগুলো গতিশীল করার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মাঠপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা যথাযথ মনে করি। তাঁরাই জাদুঘরের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহের অন্যতম উত্স হতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই মাঠপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা হয় না। একটি পরিপূর্ণ জাদুঘর বানাতে হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের দরকারি মানুষগুলোর সহায়তা অবশ্যই নিতে হবে।
মোকারম হোসেন। প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
[email protected]