চক্ষু চড়কগাছ!

নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর নিজের নির্বাচনী ক্যাম্পে ডোনাল্ড ট্রাম্প
নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর নিজের নির্বাচনী ক্যাম্পে ডোনাল্ড ট্রাম্প

সকালবেলায় টেলিভিশন খুলে চক্ষু চড়কগাছ! এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার নয়, বাংলাদেশের আরও বহু মানুষের হয়েছে। ট্রাম্প তখন এগিয়ে শুধু ফ্লোরিডা নয়, ওহাইও আর নর্থ ক্যারোলাইনা—এই দুই ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেটেও। আমি তখন ভাবি, এই তিন রাজ্যেও ট্রাম্প জিতলে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবধারিত জিতে যাবেন। কিন্তু এটা হয় কী করে? আমরা না শুনেছিলাম তাঁর ফ্লোরিডায় জেতার কথা নয়, ওহাইওতে তো আরও নয়!
সকাল নয়টা নাগাদ আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় শুনি ট্রাম্প নাকি জিততে চলেছেন ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেটের সব কটিতেই। নিজ নিজ শক্ত জায়গায় হিলারি আর ট্রাম্প জিতবেন, এটা তো জানা কথা। ব্যাটল গ্রাউন্ডেই না যুদ্ধ হবে, কে কতগুলোতে জিতলেন, তা-ই নির্ধারণ করবে কে হবেন আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট! আর ট্রাম্প কিনা জিততে চলেছেন সমস্ত যুদ্ধরাজ্যে! আমার বিস্ময় তখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশ সময় বেলা দুইটায় জানা গেল, ট্রাম্প জিতেছেন, এমনকি পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন স্টেটে, গত সিকি শতাব্দীতে যেখানে কখনো জেতেনি রিপাবলিকানরা!
কীভাবে জিতলেন ট্রাম্প? আমেরিকার মানুষ নারী রাষ্ট্রপ্রধান মেনে নিতে এখনো প্রস্তুত নয় বলে? আট বছর ধরে ক্ষমতায় হিলারির দল, তাই অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি? অতি ডান আমেরিকানদের স্বার্থপরতা? আমেরিকার অল্পশিক্ষিত আর গ্রামাঞ্চলের বেকার ও দরিদ্র মানুষের প্রতিশোধ? সিরিয়ান শরণার্থীদের প্লাবনের পর অভিবাসী ও সন্ত্রাসী আতঙ্ক? মুসলিমবিরোধী ধর্মীয় উন্মাদনা? নাকি হিলারির ই-মেইল বিষয়ে এফবিআইয়ের শেষ সময়ের ঘোষণার প্রভাব? হতে পারে সবই। কিন্তু আমরা না তারপরও শুনেছিলাম ট্রাম্প তবু হারবেন! আমেরিকার জরিপ আর বিশেষজ্ঞরা যা বলেন, তা সাধারণত ভুল হয় না। প্রায় সবাই না নিশ্চিত করে বলেছিলেন, হিলারিই জিতবেন, ট্রাম্প হারবেন!
পণ্ডিত মানুষের সমস্ত হিসাব-নিকাশ উল্টে গেছে! ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছে বানর, অক্টোপাস আর মাছের। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের এসব প্রাণী ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করেছিল, ট্রাম্প জিতবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী মাসুদ রেজা মনে করিয়ে দিলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ’ এসব প্রাণীর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছে। সিরিয়াস চেহারা করে জানান, এখন থেকে প্রাণিকুলের এসব বাণী গুরুত্বের সঙ্গেই নেবেন তিনি, কোনো জরিপের ফলাফল নয়।

২.
জরিপটরিপের কথা বাদ থাক। সাধারণ বিচারবুদ্ধিতেই বলে, ট্রাম্পের মতো একজন প্রার্থীর জেতার কথা নয় আমেরিকায়। তিনি যে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, তা নিয়েই হায়-হুতাশ ছিল, এমনকি রিপাবলিকান শিবিরেই। কোনো দিন রাজনীতি করেননি, কোনো দিন রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেননি, তাঁর মতো এমন একজন লোক কখনো আমেরিকার নির্বাচনে প্রার্থী হননি। গত ৫০ বছরে, এমনকি গভর্নর, সিনেটর বা যুদ্ধবীর জেনারেল ছাড়া কেউ আমেরিকায় বড় দুই দলের মনোনয়নই পাননি। ট্রাম্প নাহয় মনোনয়ন পেলেন, কিন্তু তিনি জিতলেন কীভাবে?
ট্রাম্প বিচারপতি, বিশ্বসুন্দরী, টিভি উপস্থাপক, যুদ্ধ-নায়কের শোকাহত পিতা-মাতা, এমনকি নিজ দলের শ্রদ্ধেয় নেতাদের সম্পর্কে নোংরা কথা বলেছেন। মুসলিম ও হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন, নারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর উক্তি করেছেন, আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। নিজ আয়করের হিসাব বারবার প্রশ্নের মুখেও গোপন রেখেছেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁকে আর সমর্থন না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলেরই বহু ডাকসাইটে নেতা। তাঁর সর্বশেষ অডিও টেপে নারীদের প্রতি তাঁর চরম অরুচিকর মন্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এমনকি তাঁর রানিং মেট পর্যন্ত। অনৈতিক ও অসৎ জীবনযাপনকারী রাজনীতিতে নবাগত এবং গণমাধ্যমে প্রবল সমালোচিত এবং নিজ দলে কারও কারও কাছে পরিত্যাজ্য এই প্রার্থী জিতবেন, আসলেই কি এটা কেউ ভেবেছিল?
উত্তর হচ্ছে, ভেবেছিল। ট্রাম্প নিজে প্রচণ্ডভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর বিজয় হতে পারে, এমন কথা বলেছিলেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞও। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। আমি নিজে বিবিসিতে কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, ব্রেক্সিট বা স্কটিশ গণভোটের মতো সমস্ত হিসাব উল্টে দিয়ে ট্রাম্প জিততেও পারেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে মতামত প্রকাশ করার সুযোগ আছে, এমন বাকি প্রায় সবাই তাঁর পরাজয় হবে ভেবেছিলেন এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর পরাজয় হোক, এটা তাঁরা চেয়েছিলেনও।
আমি নিজেও চেয়েছিলাম হিলারির বিজয়। সেটি হিলারিকে ভালোবেসে বা তিনি জিতলে বাংলাদেশে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করবেন, এই চিন্তা থেকে নয়। সেটি ট্রাম্পের প্রতি রাগের কারণে, তিনি যেভাবে নারী এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ও চরম বৈষম্যমূলক কথাবার্তা বলেন (কৃষ্ণাঙ্গরা কদাকার, মুসলিমরা সন্ত্রাসী, হিস্পানিকেরা মাদকসেবী, গর্ভপাত করা নারীরা শাস্তিযোগ্য), সে কারণে। তিনি নির্বাচিত হলে বিশ্বনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এটা ভেবে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তা-ই ভেবেছে। তারা যত না চেয়েছে হিলারির বিজয়, তার চেয়ে বেশি চেয়েছে ট্রাম্পের পরাজয়। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তা-ই চেয়েছে।
কিন্তু ভোটটা ছিল আমেরিকার মানুষের। একটি নির্বাচনব্যবস্থা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হলে মানুষের ভোটই হয় নির্ণায়ক। পণ্ডিত, গণমাধ্যম, জরিপকারী বা বিদেশিদের ইচ্ছা নয়। আমেরিকার নির্বাচন তা-ই প্রমাণ করল আবারও।

৩.
ট্রাম্পের বিজয় তারপরও মেনে নিতে পারবে না বিশ্বের বা আমেরিকার বহু মানুষ। তিনি আমেরিকার সামাজিক মূল্যবোধে আঘাত করেছেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙেছেন। তাঁর বিজয়ে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়ে কিছু আমেরিকান কানাডাপ্রবাসী হওয়ার চিন্তা করছেন, তা এখনই জানা যাচ্ছে। তিনি যা বলতেন (অভিবাসীদের বিতাড়ন, মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ, মেক্সিকো সীমান্তদেয়াল, ন্যাটো ভেঙে দেওয়া, টিপিপি বা নাফটা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন), বিজয়ী হওয়ার পর সত্যি হয়তো তা পুরোপুরি করবেন না। কিন্তু তার কিছুটাও যদি করেন, তাতেই আরও বহুবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেতে পারে বহু মানুষের। তিনি আমেরিকার ভেতরের সামাজিক সম্প্রীতি, বিশ্ব বাণিজ্যব্যবস্থা ও পরিবেশ চুক্তির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। তিনি এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার সূচনাও করতে পারেন। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, তিনি বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের আশঙ্কা পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারেন।
তিনি যা-ই করতে চান, তার পক্ষে সায় দেওয়ার জন্য সিনেট আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ, পার্লামেন্টের দুই পক্ষই রয়েছে। বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদের একটি খালি আসনে পছন্দনীয় মনোনয়ন দিয়ে সেখানেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ তাঁর রয়েছে। তবে ভরসা হচ্ছে আমেরিকার পার্লামেন্ট বা সুপ্রিম কোর্ট অনুন্নত বিশ্বের বহু দেশের মতো শাসন বিভাগের অন্ধ অনুগত নয়। ট্রাম্প তাই যা ইচ্ছা তা করতে পারবেন, এটা হয়তো সম্ভব নয় আমেরিকায়।
এমনও হতে পারে, ট্রাম্প হয়তো যা ইচ্ছা তা বলবেনও না এরপর। নির্বাচনে জেতার বক্তব্য আর নির্বাচিত হওয়ার পরের বক্তব্য পৃথিবীতে বহু দেশেই এক রকম হয় না। তিনি ইতিমধ্যে আমেরিকাকে বরং এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন। অভিবাসী, মুসলিম ও হিস্পানিকদের প্রতি সদয় কথাবার্তাও হয়তো তিনি একসময় বলবেন। তবে তিনি যে অতি বুর্জোয়া, অতি ডান ও হোয়াইট সুপ্রিমেসির রাজনীতি ধারণ করেন, তাঁর ভোটারদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হলে কিছু নতুন পদক্ষেপ তাঁকে নিতেই হবে।
মনে হয় না আমেরিকা বা বাদবাকি বিশ্বের জন্য তা সার্বিকভাবে কল্যাণকর হবে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।