তরুণেরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবেন

গত মাসে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে অনুষ্ঠিত হয়েছে এসিএম-আইসিপিসি, ঢাকা আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ২০১৬। চমৎকার এই আয়োজনের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে ধন্যবাদ ও প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি সব সময় ব্যস্ত থাকেন—পদ্মা সেতু, পানির তলে টানেল নির্মাণ থেকে শুরু করে মোবাইল কোম্পানির লেনদেনজনিত সমস্যা পর্যন্ত যার বিস্তৃতি। তবু তাঁর হাইপ্রোফাইল কাজের তালিকার বোঝার ওপর এই শাকের আঁটি বহনে পিছপা হলেন না।

প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ও ১৯ নভেম্বর। প্রিলিমিনারি প্রতিযোগিতায় রেকর্ডসংখ্যক দল অংশগ্রহণ করেছিল—৮১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৫৬৬টি দল। এবারই প্রথমবারের মতো এই প্রতিযোগিতায় মেয়েদের ১২৯টি দল অংশগ্রহণ করে। মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৫টি দল। আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন এই প্রতিযোগিতায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে তাঁদের মেধা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল নির্মাতা হবেন।

গত ১৮ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ১৯ নভেম্বর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বিশেষ অতিথি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ, সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার ও এশিয়া আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার পরিচালক অধ্যাপক সিজে হোয়াং। সকাল নয়টায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ইউএপিএর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান কাইয়ুম রেজা চৌধুরী। মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ১২৫টি দলের মধ্যে স্কুল-কলেজের দুটি দলও ছিল। ছাত্রদের উৎসাহিত করতে জামিল স্যার অনেক পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। আটটি বিভাগের চ্যাম্পিয়নদের জন্য পুরস্কার, যেকোনো সমস্যার প্রথম সমাধানকারীর জন্য পুরস্কার, স্কুল-কলেজের দলের জন্য পুরস্কার, যদিও তারা নিজেদের যোগ্যতায়ও পুরস্কার পেয়েছে। মেয়েদের দলগুলোর জন্য, শ্রেষ্ঠ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবং র‍্যাংক অনুযায়ী ১০টি দলের জন্য ছিল পুরস্কার। এ পর্যন্ত আমরা যত প্রতিযোগিতা করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবারের প্রতিযোগিতায়। পাঁচ ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় তীব্র যুদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোর মধ্যে। র‍্যাঙ্ক তালিকার পরিবর্তন হয়েছে বারবার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা কোচরা গোটা সময়টি উপভোগ করেছেন। ১০টি সমস্যার সমাধান করে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুর রশীদ, হারুনুর রশীদ ও তন্ময় মল্লিকের দল, রানার্সআপ হয় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বুয়েট অমনিট্রিক্স দল এবং তৃতীয় স্থান দখল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিইউ সেন্সর্ড দল। এরপরের দুটি স্থানও বুয়েটের দলগুলো দখল করে। প্রতিযোগিতার ভেন্যু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আদলেই বড় বড় ফেস্টুন দিয়ে সাজানো ছিল। আয়োজনের সব দিক অধ্যাপক হোয়াংকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবং তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ভেন্যু হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সমর্থন দেবেন, তা তাঁর কথায়ই বোঝা গেল।

প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা সংস্কৃতির সূচনা এবং তা বেগবান করার ফলে আমাদের কম্পিউটারের ছাত্রদের সমস্যা সমাধানের এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা যে প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ভালো দল রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই নয়, এখন ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, শাহজালাল, নর্থ সাউথসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ডিগ্রি পাওয়ার পরে কিংবা আগেই মাইক্রোসফট, ফেসবুক, গুগলসহ অত্যন্ত দামি প্রতিষ্ঠানে যে চাকরি পাচ্ছেন, তা আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষার বিশ্বমানের একটি স্বীকৃতি। আমরা এখন স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড আয়োজনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করছি। এবার রাশিয়ায় প্রাক্‌–বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে নবম শ্রেণির ছাত্র রুবাব ও রুহান রৌপ্যপদক পেয়েছে।

ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ ছিল। আমাদের কম্পিউটারের ছাত্ররা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। ১৯৯৯ সালে আমরা আইআইটি কানপুরে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম। প্রতিযোগিতার আগের দিন আইবিএম ভারতের কর্ণধার প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বললেন, ‘আজ আমরা বিশ্বসুন্দরী হয়েছি। আগামীকাল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় প্রমাণ করব মেধায়ও আমরা শ্রেষ্ঠ।’ তারপরের দিনের প্রতিযোগিতায় বুয়েট চ্যাম্পিয়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রানার্সআপ। তারপরের বছরও এই প্রতিযোগিতায় বুয়েটের দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের ছাত্রদের পারফরম্যান্স ভারতের থেকে অনেক ভালো। আমাদের ছাত্রদের তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতার এই শ্রেষ্ঠত্ব ব্যবহার করে কেন আমরা ভারতের সফটওয়্যার রপ্তানি থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে আয় করতে পারছি না তা জাতির সামনে একটি বড় প্রশ্ন। আমাদের তরুণ কম্পিউটার–বিশারদদের সারা বিশ্বের দামি দামি প্রতিষ্ঠান মাসিক সাত-আট লাখ টাকা বেতনের চাকরি দিচ্ছে কিন্তু আমরা দেশের ভেতরে যোগ্য কম্পিউটার স্নাতক খুঁজে পাচ্ছি না। প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আমাদের অর্জন কম নয়। সারা এশিয়া থেকে যে একজন বিচারক সারা পৃথিবীর মেধাবী কম্পিউটার ছাত্রদের প্রোগ্রামের শুদ্ধতা যাচাই করে থাকেন, তিনি হলেন আমাদের স্নাতক সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহরিয়ার মঞ্জুর। আমাদের অন্য বিচারকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং তাঁরা নানা দেশের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার সমস্যা রচয়িতা এবং বিচারক হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

>আমাদের সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের এই মেধাবী কম্পিউটার–বিশারদেরা সৈনিক নন, জেনারেলের ভূমিকা পালন করবেন

আমাদের ছাত্রদের গবেষণা সাফল্যও ঈর্ষণীয়, ডিগ্রি পাওয়ার আগেই আমাদের কত ছাত্র যে নামকরা জার্নালে তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সম্প্রতি আমাদের শিক্ষক ড. তানজিমা হাশেমকে আর্লি ক্যারিয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে—পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার, সঙ্গে আমেরিকা যাওয়া-আসা-থাকার সব ব্যবস্থা। তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের মেয়েরা যে পিছিয়ে নেই, এটা তার বড় প্রমাণ।

আমাদের সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের এই মেধাবী কম্পিউটার–বিশারদেরা সৈনিক নন, জেনারেলের ভূমিকা পালন করবেন। বিদেশি কম্পিউটার পণ্য ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাহলে সৌদি আরব আর কুয়েত অনেক আগেই ডিজিটাল হয়ে যেত। বাংলাদেশের তরুণেরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রচেষ্টায় আমাদের দেশে যদি প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তা হবে আমাদের দেশের জন্য মহা সম্মানজনক এবং আমাদের দেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কাছাকাছি সময়ে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য এখন থেকেই আমাদের সব রকম পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করা উচিত।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।