সপ্তম নৌবহর রওনা হওয়ার ঘোষণাটি ছিল ধাপ্পা

>একাত্তরের ২৫ মার্চ মাঝরাতে শুরু হওয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বটি নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রচণ্ড গতি পায়। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য আওয়ামী লীগ: যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১ বইয়ে লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ওই টালমাটাল সময়ের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। বইটি থেকে নির্বাচিত একটি অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য ছাপা হচ্ছে তিন পর্বে। আজ শেষ পর্ব

কিসিঞ্জারের একটি বার্তা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ১১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খানের সঙ্গে দেখা করেন। বার্তায় লেখা ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্ত ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে পাকিস্তানের উভয় অংশে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ বসে থাকবে না। ভারতকেও যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বলা হয়েছে।’ বার্তায় আরও বলা হয়, সপ্তম নৌবহর রওনা হয়েছে। এটি পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা না-ও দেখা যেতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানে তেলের যে মজুত আছে, তা দিয়ে ভারতকে দু-তিন সপ্তাহের বেশি ঠেকিয়ে রাখা যাবে না এবং এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরে এসে পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে যোগ দেবে। সুতরাং, পাকিস্তানকে আরও ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা পূর্ব পাকিস্তানকে আগলে রাখতে হবে এবং এ সময় নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলা যাবে না। এটি না হলে পাকিস্তানের দর-কষাকষির ক্ষমতা দারুণভাবে কমে যাবে।
কিসিঞ্জার তুরস্ক, ইরান, জর্ডান ও সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, যাতে পাকিস্তানকে তারা বিমান ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহ করে। সুলতান খান জানতে চান, সপ্তম নৌবহরের গন্তব্য কোথায় এবং তার কাজটা কী? ফারল্যান্ড জবাবে বলেন, নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে যাচ্ছে। তবে কী জন্য তা তিনি জানেন না। পরবর্তী ঘটনাক্রম দেখে বোঝা গেছে, এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভয় দেখানোর একটি প্রতীকী চেষ্টা। তবে এতে কোনো কাজ হয়নি। যাঁরা ওই সময় ওয়াশিংটনে ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে কংগ্রেস ও গণমাধ্যম ছিল বৈরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবিরোধী জনমত তখন তুঙ্গে। এ অবস্থায় পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চায়। সুলতান খানের ভাষ্যমতে, ‘আমি যখন ভোর চারটায় ইয়াহিয়ার ঘুম ভাঙিয়ে কিসিঞ্জারের বার্তাটি পড়ে শোনালাম, তিনি আমাকে তখনই গভর্নর মালেককে ফোন করে যেকোনো মূল্যে পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টা প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে বললেন। একই বার্তা জেনারেল নিয়াজি ও ফরমান আলীকে দেওয়া হলো।’
১৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত দুইটার সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়াকে টেলিফোন করেন। নিক্সন ইয়াহিয়াকে আশ্বস্ত করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন বন্ধু মনে করে। তিনি আরও বলেন, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সপ্তম নৌবহরকে অবিলম্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই প্রয়োজনের সময় পাকিস্তানের পাশে থাকবে। এটি শুনেই ইয়াহিয়া জেনারেল হামিদকে বলেন, ‘কাজ হয়ে গেছে, আমেরিকানরা রওনা হয়েছে।’ পরবর্তী দিনগুলোতে পাকিস্তানিরা সপ্তম নৌবহরের আশায় দিন গুনছিল। কিন্তু তা আর কখনো আসেনি।
১৪ ডিসেম্বর ভারতের বিমানবাহিনী ঢাকার গভর্নর হাউসে বোমা ফেলে। ভীতসন্ত্রস্ত গভর্নর আবদুল মোতালেব মালেক তাঁর মন্ত্রীদের নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। এর আগেই এই হোটেলকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি, সেনা প্রত্যাহার এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা শুরুর তাগিদ দিয়ে তিনটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একটি প্রস্তাব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, একটি ছিল যৌথভাবে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপানের এবং তৃতীয়টি ছিল আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম ও আরও সাতটি দেশের। সোভিয়েত ইউনিয়ন সব প্রস্তাবেই ভেটো দেয়। ১৩ ডিসেম্বর তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও নিজ নিজ সীমান্তে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপন করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবারও ভেটো দেয়।
১৪ ডিসেম্বর পোল্যান্ড যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। অনুমান করা যায়, পোল্যান্ডের প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ছিল। প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কেন ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। রাজি হলে পাকিস্তানি বাহিনী লজ্জাজনক পরাজয়, আত্মসমর্পণ এবং যুদ্ধবন্দী হওয়ার গ্লানি থেকে রেহাই পেত। প্রস্তাবের প্রথম কয়টি অনুচ্ছেদ ছিল এ রকম:
ক) পূর্বাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, শেখ মুজিবকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দিতে হবে।
খ) ক্ষমতা হস্তান্তরের পরপরই সব অঞ্চলে সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে এবং ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি শুরু হবে।
গ) যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্বাঞ্চল ছেড়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করবে।
ঘ) পশ্চিম পাকিস্তানি অসামরিক ব্যক্তি, যাঁরা বাড়ি ফিরে যেতে চান, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাঁদের যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। তাঁদের কোনো হয়রানি করা হবে না।
ঙ) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব পাকিস্তানি সেনা সরে আসার জন্য সমবেত হলে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি বলবৎ হবে। পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বাঞ্চল ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে তাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
চ) ভারত ও পাকিস্তান তাদের দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দেবে এবং সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনা শুরু করবে, যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পশ্চিমাঞ্চলে এই নীতি বাস্তবায়িত হয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের নেতা ভুট্টো এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। ১৫ ডিসেম্বর পোল্যান্ড একটি সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নাম উল্লেখ করা হয়নি, যদিও এই প্রস্তাব আগেরটির চেয়ে আলাদা ছিল না। পাকিস্তান তখনো আশা করছিল, শেষ মুহূর্তে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে।
১৫ ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়া গেল, ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের তোড়জোড় চলছে। ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদের সভায় এসে নাটক করলেন। জাতিসংঘের ‘দ্য ফার্স অ্যান্ড দ্য ফ্রড’ তিনি জানেন বলে মন্তব্য করে হাতের কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলে তিনি পরিষদের সভা থেকে ওয়াকআউট করেন। পরে অবশ্য প্রচার করা হয়েছিল যে তিনি পোল্যান্ডের প্রস্তাব ছিঁড়ে ফেলেছেন।
১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভারতীয় দুটি বিমান থেকে ঢাকায় প্রচারপত্র ছাড়া হয়। প্রচারপত্রে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক কমান্ডকে উদ্দেশ করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজির সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৬ ডিসেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জেনারেল অরোরা একটি হেলিকপ্টারে করে সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন। তাঁর সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেছিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হয় ২৫ মিনিট দেরিতে। ভারতীয় সময় বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]