বিজয়ের পতাকা উড়েছিল এক দিন পর

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় যখন রেসকোর্সের ময়দানে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে সই করছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজি, তখন চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছিল যৌথ বাহিনীর। মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিসেনা ও ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সৈন্যদের যৌথ বাহিনী প্রাণঘাতী এক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি সেনাদের হটিয়ে ভাটিয়ারি এলাকায় এসে পৌঁছেছে। ঢাকায় কী ঘটছে তখনো জানতে পারেনি যৌথ বাহিনীর সেনারা। সম্ভবত এখানে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনারাও জানত না যে ঢাকায় ততক্ষণে কাগজে-কলমে নির্ধারিত হয়ে গেছে যুদ্ধের পরিণতি।
বস্তুত, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের আগে ৮-১২ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের ফ্রন্টলাইনগুলোর পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছিল যৌথ বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি
সেনারা। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ছিল মুক্তাঞ্চল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর ছিল এর ব্যতিক্রম।
চট্টগ্রাম সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ৯ ডিসেম্বর শুভপুর ব্রিজ এলাকা দিয়ে ফেনী নদী অতিক্রম করে জোরারগঞ্জে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে। তাদের ধারণা ছিল, মিরসরাইয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু একজন গেরিলা বেজ কমান্ডার এসে মেজর রফিককে বলেন, মিরসরাই থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে সরে গিয়ে সীতাকুণ্ড এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তুলেছে পাকিস্তানিরা। প্রায় বিনা প্রতিরোধে মিরসরাই পেরিয়ে সীতাকুণ্ড পৌঁছে যায় মুক্তিবাহিনী। ১১ ডিসেম্বর ছোটখাটো সংঘর্ষের পর সীতাকুণ্ডের বাধাও অতিক্রম করে মুক্তিবাহিনী। এর মধ্যে কুমিল্লা-চাঁদপুর ফ্রন্টে লাকসাম মুক্ত করে ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর নেতৃত্বে ভারতের ৮৩ ব্রিগেড এসে যোগ দেয় মুক্তিসেনাদের সঙ্গে। এবার যৌথ বাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার পালা। কিন্তু কুমিরায় পৌঁছে প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় যৌথ বাহিনী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিরা ব্রিজটি উড়িয়ে দিয়ে খালের দক্ষিণ পাড়ে একটি শক্তিশালী ফ্রন্টলাইন তৈরি করে পাকিস্তানিরা। পূর্বে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত যক্ষ্মা হাসপাতাল (এখন পরিত্যক্ত), পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে দুপক্ষের ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়।
১৩-১৫ ডিসেম্বর প্রায় তিন দিন ধরে চলে এই যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে বেশিসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়েছে এমন সব যুদ্ধের মধ্যে এই যুদ্ধ অন্যতম। এখানে বহু পাকিস্তানি সেনা যেমন হতাহত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাও প্রাণ হারিয়েছেন।
২০০৮ সালে প্রকাশিত লেখক-গবেষক সালাম আজাদের লেখা রোল অব ইন্ডিয়ান পিপল ইন লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ গ্রন্থে বলা হয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধে ৩ হাজার ৬০০-এর বেশি ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ান নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৮ হাজার এবং নিখোঁজ হয়েছেন ২৫০ জনের মতো।
১৫ ডিসেম্বর কুমিরা ফ্রন্টলাইন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ শুরু করে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি ভাটিয়ারি এলাকায় আবার যুদ্ধ হয় উভয় পক্ষের। এতে যৌথ বাহিনীর প্রায় ২০ জন সেনা মারা যায় এবং যৌথ বাহিনীর সাময়িক গতি রোধ করতেও সক্ষম হয় পাকিস্তানিরা।
কিন্তু মুক্তিসেনা ও মিত্রবাহিনীর যোদ্ধারা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম শহরকে মুক্ত করতে। রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম (তৎকালীন মেজর রফিক) তাঁর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থে এক কিশোর যোদ্ধার আকাঙ্ক্ষা ও উত্তেজনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: ১৫ ডিসেম্বর ভাটিয়ারির কাছেই একটি গ্রাম মুক্ত হলে সেই গ্রামেরই ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে আমি ১২ ঘণ্টার ছুটি দিয়েছিলাম তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ওই কিশোর আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গর্বের সঙ্গে বলল, ‘না স্যার, চট্টগ্রাম শহর মুক্ত হওয়ার পরই আমি বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি যাব, তার আগে নয়।’

>অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রাম ছিল মুক্তাঞ্চল। কিন্তু চট্টগ্রাম শহর ছিল এর ব্যতিক্রম

১৬ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত ভাটিয়ারিতে চলছিল লড়াই। এ সময়টারও মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায় রফিকুল ইসলামের বইয়ে: ‘হয়তো ঠিক ওই মুহূর্তেই নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে। ১৫০ মাইল দূরে ভাটিয়ারিতে সুবেদার আজিজের কোম্পানির মাঝখানে এসে পড়ল পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা। মারাত্মকভাবে আহত হলো সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। গোলাগুলি তখনো চলছে। কিছুক্ষণ পর ভাটিয়ারির দক্ষিণ দিক থেকে একজন পাকিস্তানি মেজর একটি সাদা পতাকা উড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে খালের পাড় পর্যন্ত। আমিও এদিক থেকে খালের পাড় পর্যন্ত চলে এলাম। পাকিস্তানের ওই মেজর আমাকে বলল যে তারা নিয়াজির কাছ থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ পেয়েছে এবং এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়। এমন সময়ই আমার কাছে খবর এল যে সুবেদার আজিজ এবং ওই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছে।’
চট্টগ্রাম শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে যখন এই আনন্দ-বেদনার ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল তখন কী অবস্থা ছিল শহরের?
বিএলএফের বিস্ফোরণ ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং কর্ণফুলী কোম্পানি-৪-এর সদস্য রইসুল হক বাহার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ৬ ডিসেম্বরের পর কোনো একদিন (হুবহু তারিখ মনে নেই) তাঁদের কাছে নির্দেশ এসেছিল তাঁরা যেন অস্ত্রশস্ত্র কোথাও লুকিয়ে রেখে কর্ণফুলী নদীর ওপারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ, ওই মুহূর্তে আর গেরিলাযুদ্ধের প্রয়োজন নেই, মিত্রবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে বিমান হামলার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর ঠিক এক দিন পরই আবার নির্দেশ এল নদীর ওপারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ফেনীর দিক থেকে স্থলবাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিজয় যে আসন্ন, সবাই তা বুঝতে পারছিলেন। রইসুল হক বাহার বলেন, বিবিসি, ভয়েস আমেরিকা, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর শুনে চট্টগ্রামের পাড়ায়-মহল্লায় আনন্দ-উল্লাস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মূল সড়কগুলোতে লোকজন নেমে আসতে পারছিল না। কারণ, পাকিস্তানি সৈন্যরা তখনো ক্যান্টনমেন্টে, নৌ ও বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান করছিল। এমনকি শহরের পাহারা-চৌকিতেও সেনা মোতায়েন ছিল।
পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ভাটিয়ারির খাল পেরিয়ে এপার থেকে মেজর রফিক একটি গাড়ি নিয়ে চলে এলেন সার্কিট হাউসে। যৌথ বাহিনীকে স্বাগত জানাতে তখন পথে পথে অসংখ্য লোক অপেক্ষা করছিল। আবার অনেকেই নিশ্চিত হতে না পেরে বাড়িঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল এবং পরস্পরের কাছ থেকে খোঁজখবর নিচ্ছিল। পাকিস্তানি সেনারা তখন বাসে-ট্রাকে চেপে প্রাণভয়ে পালাচ্ছিল ক্যান্টনমেন্ট ও নৌঘাঁটির দিকে।
মেজর রফিক সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের একটি পতাকা। এক কিশোরের হাতে তিনি তুলে দিলেন সেই পতাকা। সেই কিশোর সার্কিট হাউসের ফ্ল্যাগ-স্ট্যান্ড থেকে পাকিস্তানি পতাকাটি নামিয়ে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশের পতাকা। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল চট্টগ্রাম শহরে। জয় বাংলা স্লোগানে তখন মুখর পুরো নগর। নিঃসংশয় হাজার হাজার মানুষের সব পথ এসে মিলে যায় সার্কিট হাউসের সামনে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]