আমাদের ঢাকা আর ফিদেলের হাভানা

ঢাকায় এমন অনেক কিছুই আছে, যা হাভানায় দেখা যায় না
ঢাকায় এমন অনেক কিছুই আছে, যা হাভানায় দেখা যায় না

এক দশক আগে যখন ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনের সূত্রে কিউবায় গিয়েছিলাম, তখন ফিদেল কাস্ত্রোর অসুস্থতার শুরু। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমার বেশি আগ্রহ ছিল কিউবার সমাজের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির অনুসন্ধান। সে কারণে ফিদেলের সহযাত্রী অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘুরেছি অনেক স্থানে, প্রতিষ্ঠানে। চারদিকে সমুদ্র আর একটু দূরের ভয়ংকর প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মধ্যে কিউবা কীভাবে মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে ভিন্ন এক সমাজ গড়ে তুলেছে, তা এক বিশাল প্রশ্নই বটে। ‘বাংলাদেশের সম্পদ নেই’—কিউবার সম্পদ আরও কম। ‘বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি নেই’—কিউবায় আরও কম ছিল। ‘বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি’—কিউবায় তার থেকে কয়েক গুণ বেশি দুর্যোগ হয়। ‘বাংলাদেশে দুর্নীতি বেশি’—একসময় কিউবাও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের কর্তৃত্বে ছিল। ‘বাংলাদেশে ক্ষুদ্র দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য’—কিউবাও এ রকম আধিপত্য মোকাবিলা করেই নতুন জন্ম লাভ করেছে। তবে?

প্রচলিত জিডিপি মার্কা সূচক দিয়ে কিউবার উন্নয়ন বোঝা যাবে না। আমাদের ঢাকার সঙ্গে ফিদেলের হাভানার তুলনা করলে তার কিছু বিষয় হয়তো পরিষ্কার হতে পারে। ঢাকায় এমন অনেক কিছুই আছে, যা হাভানায় দেখা যায় না। যেমন ঢাকা শহরে চোখ–ধাঁধানো অসংখ্য বহুরঙা আলোকোজ্জ্বল বিলবোর্ড চোখে পড়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু নেতা-নেত্রীর প্রচার আর তার বাইরে বিজ্ঞাপনই বেশি। আহ্বান মোবাইল কেনার, ব্যাংকে আমানত খোলার, কোমল পানীয় পানের, পণ্য কেনার কিংবা কোনো না কোনো সুপারমার্কেট বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রাইভেট ক্লিনিকে আসার মোহময় আমন্ত্রণ। ঢাকা শহরে তৈরি হয়েছে আলোকোজ্জ্বল অনেকগুলো বৃহৎ শপিং মল। মানুষ এগুলো দেখতে যায়, কিনতে এমনকি বেড়াতেও যায় সেসব জায়গায়। নদী দূষিত বা দখলে, বেড়ানোর খোলা জায়গা, পার্ক ভরে গেছে মল আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়িতে। সুতরাং, এসব মলই এখন বেড়ানোর জায়গা।
ফিদেলের হাভানায় এসব কিছুই দেখিনি! পণ্য কেনার জন্য কোনো বিলবোর্ড নেই, নেই আলোকোজ্জ্বল এ রকম বিলাসী কোনো শপিং মল। বেড়ানোর জন্য সেখানে শপিং মলে যেতে হয় না। কেননা, এখনো সেখানে অসংখ্য খেলার মাঠ আছে, আছে বটগাছ, পার্ক ও খোলা জায়গা। মানুষ সেসব জায়গায় ভিড় করে। ছেলেরা মেয়েরা শিশুরা খেলছে, এ রকম দৃশ্য পাড়ায় পাড়ায়, প্রতিদিনের। বসে আছে, গল্প করছে এবং অতি অবশ্যই কোথাও না কোথাও গান হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে শিল্পী এবং সমবেত নারী-পুরুষের নাচ। এগুলো আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রতিদিনের সাধারণ অভিজ্ঞতা। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত গান আর নাচের এ রকম সমারোহ আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ছিল, এত মাঠ আর খেলাধুলার দৃশ্য, সেটাও নতুন। ঢাকায় আমরা এর জন্য হাহাকার করি।
হাভানার বিভিন্ন স্থানে ফিদেল কাস্ত্রোর বিশাল বিশাল ছবি দেখলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু তাঁর কোনো ছবি ছিল না। তবে শহরজুড়ে দেখেছি বিপ্লবী কবি দার্শনিক হোসে মার্তির ছোট-বড় ছবি। আর সবচেয়ে বড় ছবিটি চে গুয়েভারার। বিলবোর্ড হাভানাতেও আছে। কিন্তু সেগুলোতে অন্য সংবাদ। তাতে কোথাও নারী, কোথাও শিশু, কোথাও সমবেত মানুষের ছবি। এগুলো কিছু কিনতে প্রলুব্ধ করে না, উন্মাদ করে না; এগুলো দুনিয়া সম্পর্কে সজাগ করে, অন্য দেশের মানুষের প্রতি সহমর্মী করে। যেমন ‘ইরাক, আফগানিস্তানসহ দুনিয়াজুড়ে মার্কিনদের গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা’, কোথাও ‘আমাদের আমেরিকা আমাদের, যুক্তরাষ্ট্রের নয়’, কোথাও ‘বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের পাশে আছে কিউবার মানুষেরা’, কোথাও ভালোবাসার কথা—মানুষ আর প্রকৃতির জন্য।
ঢাকায় এখন শিক্ষা ও চিকিৎসার বাণিজ্যের ব্যাপক আয়োজন। শহরের কোনো কোনো এলাকায় বহুসংখ্যক, প্রায় অগণিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের সংখ্যাও অগণিত। ঢাকায় গরিবদের জন্য এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য স্বল্পব্যয়ের চিকিৎসার অন্যান্য ব্যবস্থাও আছে। ‘স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ’, ‘আধ্যাত্মিক শক্তির ওষুধ’, ‘পানি পড়া ফুঁ দেওয়া ওষুধ’, ‘পীর–ফকিরের কেরামতি’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেরও কম ভিড় নেই।
শিক্ষা বা চিকিৎসাক্ষেত্রে এ ধরনের বাণিজ্যিক কোনো প্রতিষ্ঠানই হাভানায় নেই। কেননা কিউবার সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা করা রাষ্ট্র নিজের ন্যূনতম দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। সে জন্য হাভানার সবচেয়ে বড় ভবন শপিং মল নয়, মেডিকেল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। হাভানাসহ পুরো কিউবাতে দেখেছি প্রতি ১০০ পরিবারের জন্য একটি চিকিৎসক টিম আছে। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় হাসপাতাল, বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসার সুবিধা নিয়ে। ফিদেল যে চিকিৎসা পেয়েছেন একই চিকিৎসা সে দেশের প্রতিটি নাগরিক পান। তাঁর জন্য টাকাপয়সাও লাগে না, তদবিরও নয়। বাংলাদেশের মতো কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান তো বটেই কোনো নাগরিককেই আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হয় না। কেননা, যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো চিকিৎসা সহজে বিনা পয়সায় সে দেশেই পাওয়া যায়। শিক্ষকও তা–ই। আর এই শিক্ষা-চিকিৎসা নিয়েই ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দিনরাত দুর্ভাবনা।
ঢাকা শহরে এখন প্রায় দেড় কোটি মানুষ। দারিদ্র্যসীমা সম্পর্কিত সরকারি স্থূল মানদণ্ডের হিসাবেও এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আশ্রয়, কাজ, খাওয়া, চিকিৎসা, শিক্ষা—সবকিছু বিবেচনায় নিলে শতকরা ৯০ ভাগেরই অবস্থা সঙিন। এই ঢাকা শহরেই কোটি টাকার ব্যক্তিগত গাড়ি চলে। বহু কোটি টাকার ব্যক্তিগত প্রাসাদও এই শহরেই আছে। শত হাজার কোটি চোরাই টাকার মালিকদের অধিকাংশ এই ঢাকাতেই বাস করেন। এঁদের দাপটে রাস্তা কাঁপে, সর্বজনের খোলা জায়গা দখল হয়, বিল-খাল ভরাট হয়, গাছপালা উধাও হয়, দেশের নানা সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের বন্দোবস্ত হয়। বিশাল জৌলুশের পাশে লক্ষাধিক মানুষ পুরোপুরি রাস্তাবাসী। ফুটপাত, আইল্যান্ড, মার্কেটের সামনের বারান্দা, বাজারের ঝুপড়ি, ভ্যান ইত্যাদি। রাতে বা ভোরে ঢাকার রাস্তায় বের হলে দেখা যায়, হাজার হাজার অস্থায়ী ঘর, মশারি সমান, নানা কাপড় দিয়ে বানানো তার মধ্যে গোটা পরিবার কিংবা কয়েকজন মানুষ। একেবারে খোলা অবস্থাতেও অনেক মানুষ পাওয়া যাবে। যাদের অবস্থা একটু ভালো তারা বস্তিতে, যেখানে ঘন ঘন আগুন লাগে। নিরাপত্তা বা সৌন্দর্যবর্ধনের অছিলায় প্রথমেই এদের ওপর হামলা করে পুলিশ।
হাভানায় এ রকম রুচিহীন বিত্তের প্রদর্শনী বা অসহনীয় দারিদ্র্য—কোনোটিই নেই। সব মানুষের আবাসন কিউবা নিশ্চিত করেছে বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই। সে জন্য হাভানা শহরের কোথাও কোনো নিরাশ্রয় মানুষ দেখিনি। কোথাও দেখিনি বিপন্ন নারী বা পরিত্যক্ত শিশু। আলোকোজ্জ্বল ঢাকার মতো হাভানায় মানুষের পরাজয় আর অপমান দীর্ণ চেহারা দেখিনি কোথাও। কিউবার শৈশবহীন শিশু এবং অবসরহীন বয়স্ক মানুষ দুটোর কোনোটারই কোনো চিহ্ন দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। দিনে-রাতে, ঘরে-বাইরে নারীর জন্য নিরাপদ জীবন ও সচলতা এই শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
সন্ত্রাসী মাস্তানদের আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি দিন শুরু করে ঢাকাবাসী। কিউবার মানুষের কাছে সন্ত্রাসী গডফাদার বলতে কেবল বোঝায় মার্কিন প্রশাসন আর তাদের আশ্রিত মায়ামির কিউবান মাফিয়া গোষ্ঠী। কিন্তু দেশের ভেতরে কিংবা হাভানায় সন্ত্রাসী কিংবা তাদের গডফাদারদের কোনো সম্ভাবনার কথাও কেউ চিন্তা করতে পারে না। সে জন্য ঢাকা শহরের মতো দিনে-রাতে চলাফেরায় মানুষদের মধ্যে ত্রস্ত, আতঙ্কিত কোনো ভাব নেই।
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে প্রথম অগ্রাধিকার ভিআইপি, শপিং মল ইত্যাদি। ঢাকা শহরের কোনো কোনো শপিং মলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তা বাংলাদেশের অনেক জেলা শহরের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে মন্ত্রী-আমলাদের অপচয়ে শানশওকতে অর্থ পাওয়া যায়, শিক্ষা আর চিকিৎসায় সব সময়ই অর্থের অভাব। কতিপয় গোষ্ঠীর অপচয়, লুণ্ঠন আর দুর্নীতির অর্থ জোগান দিতে বাংলাদেশের মানুষকে জীবন জীর্ণ করতে হয়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করতে হয়।
সম্পদের সংকট কিউবাতে যথেষ্টই আছে। ছয় দশকে মার্কিন অবরোধে নিজের ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করতে পারেনি কিউবা। তারপরও যেখানে সম্পদ সীমিত, সেখানে অগ্রাধিকার বিবেচনা থেকে তাদের উন্নয়ন-দর্শন পরিষ্কার হয়। যেমন যখন বিদ্যুতের সংকট থাকে, তখন অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকে হাসপাতাল, তারপর শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, উৎপাদনশীল খাত। মন্ত্রী-নেতাসহ সব বাসাবাড়ি সবার পরে। এসি চালানো খুবই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু হাসপাতাল, লাইব্রেরি, গবেষণাগারে এসি বা বিদ্যুৎ অবশ্যই থাকবে। যতটুকু সম্পদ থাকবে তার ব্যবহারে প্রথম অগ্রাধিকার সবার খাদ্য, শিক্ষা ও গবেষণার প্রসার এবং সবার আবাসন নিশ্চিত করা।
কদিন আগে এই কিউবার সবার ফিদেল মারা গেলেন। গত কয়েক দশকে তাঁকে হত্যা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বহুবার চেষ্টা করেছে, পারেনি। ছোট্ট দেশ সামরিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রকে কয়েক দশক ধরে মোকাবিলা করেছে, যা সামরিক শক্তি দিয়ে কখনোই সম্ভব ছিল না, সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন মানুষের শক্তিতে। ফিদেলের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে মানুষের সঙ্গে তাঁর অবিচ্ছিন্নতার কারণে। সর্বজনের জীবনের আনন্দ আর নিরাপত্তার বিনিময়ে কতিপয়ের মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থনীতি আর রাজনীতি গত কয়েক দশক ধরে অবিরাম ধাক্কা দিয়ে গেছে কিউবাকে। প্রতিবছর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এই ধাক্কা মোকাবিলা করেই কিউবা বিশ্বের মধ্যে একটি মানবিক দ্বীপ তৈরি করেছে। এই ধাক্কা এখন আরও বাড়বে, সন্দেহ নেই। ফলাফল যা–ই হোক, ফিদেল যে এক জীবনে অসংখ্য নারী-পুরুষের স্বপ্ন ধারণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যে উন্নয়ন–দর্শন বাস্তব রূপ দিয়েছেন, যে মানবিক মর্যাদার অসাধারণ নির্মাণ করেছেন, তা আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে তাকাতে নিশ্চয়ই শক্তি জোগাবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]/[email protected]