কোচিং-বাণিজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি

বাঙালির সৃজনশীল কেরামতি বহুত। ‘গণটোকাটুকি’ বলে এক শব্দ সে বিশ্ব শব্দভান্ডারে যোগ করেছিল প্রায় অর্ধশতক আগেই, যখন স্বাধীনতার সূর্য কেবল অরুণ আভা ছড়াচ্ছিল। টিক মারা বিদ্যা চালু করে দেশের তাবৎ সন্তানকে তারকা-পণ্ডিত বানানো, তা–ও তিন দশক হয়ে গেল। তারপরের আবিষ্কার ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’। এ পদ্ধতি এতটাই ধন্বন্তরি বলে প্রমাণিত যে বাঙাল মুলুকে এখন বাচ্চাকাচ্চাদের কিচ্ছু শিখতে হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য ও ভয়ংকর বিষয় হলো, সে শিশুর খেলাধুলা, আনন্দ বিনোদন সব চুরি হয়ে গেছে ‘কোচিং পণ্ডিতদের’ ওস্তাদিতে!

কিন্তু ৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরটা পড়ে আমি রুদ্ধবাক্। ‘শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদে: বৈধতা পাচ্ছে কোচিং-টিউশনি, সহায়ক বই থাকবে’ শিরোনামে প্রকাশিত এই খবর আমাকে স্তম্ভিত করেছে। খসড়া আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘ছায়া শিক্ষা’ নামে নোট-গাইড ছাপার অবাধ লাইসেন্স পেতে যাচ্ছে ‘বিদ্যা-বণিকেরা’। একই সঙ্গে টাকা বানানোর সহজ উপায় ‘কোচিং-বাণিজ্য’ও। খোদ উজিরে ইলম নাকি জানেন, কোচিং-বাণিজ্যে ৩২ হাজার কোটি টাকা ধান্দাবাজদের গোলায় জমে। এ খবরে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা শুধু বিস্ময় নয়, হতাশা আর ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। এই খসড়া এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্যের স্পর্ধা দেখিয়েছে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘এত বছর ধরে এগুলো (নোট-গাইড, কোচিং) বন্ধে জাতীয় সংসদ, উচ্চ আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো তাহলে সঠিক ছিল না বলতে হবে।’
খসড়ায় নোট-গাইডের অবাধ বাণিজ্যকে ‘ছায়া শিক্ষা’ নামক ‘ভুতুড়ে পদ্ধতির উদ্ভাবন’ ঘটিয়েছে বঙ্গ কেরানি শিরোমণিরা। এখন শিক্ষা-বণিকেরা একটা আইনি বৈধতা পাবে, আর দেদার সৃজনশীল ছায়া শিক্ষার নামে নোট-গাইড আর কোচিং-ব্যবসা করবে। লাটে উঠবে বাঙালির শিক্ষাস্বপ্ন। মূল শিক্ষা নয়, ‘শিক্ষার ছায়া’!

>‘সৃজনশীলতা’য় বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের কোশেশ। ব্লুম সাহেবকে বোকা বানিয়ে বাঙালি পণ্ডিত আর কেরানিরা ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’কে রাতারাতি ‘সৃজনশীল’ তকমা এঁটে দিল

বাঙালি শিশু জন্মেই পরীক্ষায় বসে। প্রথম পরীক্ষা ‘নামীদামি’ ইংরেজি স্কুলে ভর্তির। তারপর প্রতিদিন তার স্কুলে, কোচিং সেন্টারে, বাড়িতে ‘টেস্ট’ দিতে হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে তাকে ‘সমাপনী’ পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন প্লাসের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয়। তার পরীক্ষা আর শেষ হয় না। জুনিয়র, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর কত কত পরীক্ষা! এসব পরীক্ষায় পাস মেলে সহজেই, তবে তা কেবল কোচিং সেন্টারে নোট-গাইড ইয়াদ করে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার মতো দুঃস্বপ্ন দ্বিতীয়টি নেই। মিডিয়া তাকে যথার্থ নাম রেখেছে, ‘ভর্তিযুদ্ধ’! সে যুদ্ধে মহাবীর রুস্তমও ভয় পেতেন। কিন্তু বঙ্গবীর বলে কথা। তারা বীরদর্পে সে যুদ্ধে শামিল হয় লাখে লাখে। ফেলও মারে লাখে লাখে! সে যুদ্ধে জিত যার, দামি ‘সার্টিফিকেট’ তার ঘর আলো করে বটে, কিন্তু জীবিকার পরীক্ষায় সে গাড্ডা মারে; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়। অবশেষে সে নাম লেখায় মাস্তানিতে, নয়তো কষে ইয়াবা, ফেন্সি, হেরোইন ধরে আর ধুঁকে ধুঁকে মরে।
বছরের পয়লা দিনে ৬ থেকে ১২ বছরের শিশুরা উৎসব করে নয়া কেতাব খয়রাতি নিতে স্কুলে ছোটে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়ার আগেই তার ব্যাগ, টেবিল ভরে যায় বিদ্যা-বণিকদের দামি মোটা মোটা কেতাবে। শুধু পড়ুয়া নয়, সেসব মোটা দামি ‘সৃজনশীল কেতাবে’ পণ্ডিতের ড্রয়িংরুম, স্কুলের আলমারির আভিজাত্য ঘোষণা করে। সরকারের কোটি কোটি টাকার বই স্কুল থেকে বাড়ি পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে না। তার আগেই সে কেতাব মুদি দোকানে জিরা-মসলা বিক্রির ঠোঙা হয়। বিশ্বাস না হলে ফকির থেকে ধনীর সন্তানের ব্যাগ, টেবিল, স্কুলের আলমারি, পণ্ডিতদের ড্রয়িংরুমে অভিযান চালিয়ে দেখতে পারেন।
এর মাজেজা সবাই জানে। ‘সৃজনশীলতা’য় বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের কোশেশ। ব্লুম সাহেবকে বোকা বানিয়ে বাঙালি পণ্ডিত আর কেরানিরা ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’কে রাতারাতি ‘সৃজনশীল’ তকমা এঁটে দিল। কাব্যিক নামে বাঙালি সন্তান সব রবীন্দ্রনাথ হবে! তাতে গণমানুষের শঙ্কা যতই বাড়ুক, জয়ধ্বনি তুলল বণিককুল। তারা ফাঁকফোকরের সন্ধান জেনে এতটাই সৃজনশীল হয়ে উঠল যে বাংলাবাজার থেকে দেশের দুর্গমতম গ্রামে এখন ‘সৃজনশীল গাইডে’র বন্যা। কিন্তু ফাঁড়া একটা কাটছিল না কিছুতেই। কর্তারা ১৯৮০ সালে এক সেনাশাসকের করা আইনের ফাঁদে মাঝেমধ্যেই আটকে যাচ্ছিলেন। সে সেনাশাসক আইন করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব ধরনের নোট-গাইড প্রকাশ, বিক্রি ও মজুত নিষিদ্ধ করে গেছেন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ তা শুধু বহালই নয়, তার গিঁরে আরও শক্ত করে বাঁধতে গিয়েছিল। তর্জন-গর্জনও ছিল বিস্তর। তাতে মেজাজ চড়ে বিদ্যা-বণিকদের। কিন্তু তারা ‘অসারের তর্জন-গর্জন’ কী বস্তু আর কোন তাবিজে তা ‘খামোশ’ করা যায়, তা ভালোই জানে। তাদের ক্ষোভ আর ‘তদবিরে’ শিক্ষা আইনে ‘ছায়া শিক্ষা’ নামক ভৌতিক আবিষ্কার নাকি আইনে রূপ নিতে যাচ্ছে।
এক কেরানি সে খসড়ার যে মাহাত্ম্য গণমাধ্যমকে ফরমিয়েছেন, তাতে এ ‘মহৎকর্ম’ এতটাই ফ্রিডম ভোগ করবে যে সরকারের কোনো ‘অনুমতি’ নেওয়ারও দরকার পড়বে না বিদ্যা-বাণিজ্যের সওদাগরদের! রাস্তাঘাটে, ফেরিতে এখন নোট-গাইডের দেদার ধান্দাবাজি জায়েজ হবে। এত দিনে বাংলার শিক্ষা নামক তোতা পাখি আসল আজাদি হাসিল করতে যাচ্ছে!
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
[email protected]