সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে উত্তরণ

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

জোহরা তাজউদ্দীন সশরীরে বাংলাদেশের আন্দোলনে-সংগ্রামে বিযুক্ত হয়ে গেলেন ২০ ডিসেম্বর, ২০১৩ থেকে। কিন্তু দীর্ঘ জীবনের (১৯৩২-২০১৩) রাজনৈতিক-মানবাধিকার-নারী আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার গৌরবে তিনি স্মরণীয় থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে (১৯৭১) পরিচালিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর স্বামী। সাধারণ একজন গৃহিণীর জীবন থেকে চার সন্তানের মায়ের মাতৃত্ব থেকে জোহরা তাজউদ্দীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জনগণের নেতৃত্বে সমাদৃত হলেন। তাঁর এই রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটেছে ১৯৬৮-৬৯ সালে। সামরিক আইন ভঙ্গ করে সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্রীদের মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটা, ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদকে গুলি করে হত্যা—এসব ঘটনার প্রতিবাদে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ২৪ জানুয়ারি এবং ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে নারীদের শোক মিছিল হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নওয়াবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে যায়। সেসব মিছিলে জোহরা তাজউদ্দীন যোগ দিয়েছিলেন। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে নারীসমাজের বিবৃতি সংগ্রহ করার জন্য আমরা কয়েকজন সে সময়ে রাজবন্দী সাহায্য কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জোহরা তাজউদ্দীনের ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছিলাম। রান্নাঘর থেকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে তিনি আমাদের আপ্যায়ন করালেন। তাজউদ্দীন আহমদ তখন রাজবন্দী ছিলেন ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে। রাজবন্দী স্বামীর সঙ্গে কারাগারে আটক সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে আমাদের অনুরোধে বিনা দ্বিধায় তিনি বিবৃতিতে নিজের নাম লিখলেন। ষাটের দশকের রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্দরমহল থেকে তিনি জনগণের কাতারে শামিল হয়েছিলেন। আর থামেননি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সংগ্রামী নেতার স্ত্রী হিসেবে প্রথমত তিনি রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলনের এবং নারী নেতা-কর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ব্যক্তিপরিচয়ের গণ্ডি থেকে অচিরেই তিনি বেরিয়ে এলেন। নিজ আদর্শিক সংগ্রামের বলিষ্ঠতায় রাজনীতিবিদ এবং নারীনেত্রী পরিচয়ে সবার প্রিয় ‘রাজনৈতিক নেত্রী’ এবং ‘জোহরা আপা’ হলেন।
তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ এবং নুরুন্নাহার সামাদ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রথম দিকে জোহরা তাজউদ্দীন নেতৃত্বে যাননি। ১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক দলমত ও আদর্শের ঊর্ধ্বে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার, নানা স্তরের মানুষ নিজ নিজ দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিল। সারা দেশে তখন সামরিক শাসনবিরোধী স্বাধিকারের আন্দোলন জোরদার ছিল। সে সময় রাজনৈতিক দলমত ও আদর্শের ঊর্ধ্বে সব শ্রেণী ও স্তরের নারীদের সংগঠিত প্রয়াসে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’। জোহরা আপা সানন্দে এই মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন।
সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে আহ্বায়িকা হিসেবে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে গিয়ে অন্যান্য ছাত্রনেত্রী যথা ফওজিয়া মোসলেম, আয়শা খানম, মাখদুমা নার্গিস, কাজী মমতা হেনা, মুনিরা আক্তার, ফরিদা আক্তার প্রমুখের যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি। মহিলা সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন সদস্য যথা জোবেদা খাতুন চৌধুরী, বদরুন্নেসা আহমদ, জোহরা তাজউদ্দীন, কামরুন নাহার লাইলী, লায়লা সামাদ, নুরুন্নাহার সামাদ, আমেনা আহমেদ, নূরজাহান মুরশিদ, সেলিনা বানু, নুরজাহান কাদের, সেলিনা খালেক, হেনা দাস, সারা আলী, রাজিয়া বানু প্রমুখ নেত্রীকে সম্মত করিয়ে দলমত-নির্বিশেষে একটি সংগ্রামী নারীমঞ্চে সংগঠিত করার কাজে উল্লিখিত ছাত্রনেত্রীরা সহায়তা করেছিলেন। আমাদের সবার সঙ্গে কমিটির সব নেত্রী এবং বিশেষত, জোহরা তাজউদ্দীনের সম্পর্ক ছিল খুবই খোলামেলা ও ঘনিষ্ঠ।
এখনো সেসব দিনের কথা মনে পড়ে। উদার হাস্যোৎ ফুল্ল ছিলেন তিনি। কথা বলতেন হাসিতে প্রাণ ভরিয়ে। দিলখোলা প্রাণবন্ত উচ্ছলতা নিয়ে রাজনীতির কথা বলতেন তখনকার ৩৭ বছর বয়সের জোহরা আপা। কখনো সেই হাস্যরসদীপ্ত বিশেষ বাচনভঙ্গিটি তিনি হারিয়ে ফেলেননি। নারী আন্দোলনের কমিটি সভায়, সেমিনারে এবং পথসভায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তিনি সহজবোধ্য সাবলীল ভাষায় বলতেন। সব সদস্যার সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশতেন। ১৯৬৯ সালে তিনি যেমন ছিলেন সহজ অন্তরঙ্গ, তেমনি সহজ রয়ে গিয়েছেন জীবনের শেষ দিনগুলোতেও। তাঁর সঙ্গে ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত নিয়মিত, অনিয়মিত যতবার দেখা হয়েছে কাছে টেনে নিয়েছেন উৎ ফুল্ল হাসিতে পরম স্নেহে। এরপর খুব বেশি দেখা হয়নি। যে দু-একবার দেখা করেছি ২০১৩ সালে; তখনো সেই আপ্যায়ন জানিয়েছেন গভীর আন্তরিকতায়। মনে রেখেছেন নারী আন্দোলনের একসময়ের তরুণ—পরবর্তী সময়ে প্রবীণ সবাইকে। সুফিয়া কামালকে হারানোর তীব্র দুঃখ জানিয়েছেন। নারীনেত্রী বেলা নবীর অকালমৃত্যুর খবরেও তিনি বিচলিত হয়েছেন। শোকে-দুঃখে-বেদনায় তিনি শোকাকুল হতেন।
আজ তাঁকে হারিয়ে আমরা শোকাকুল। নারী অধিকার বিষয়ে তাঁর হূদয় উৎ সারিত কথাগুলো ছিল দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব বৈষম্য-নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বক্তব্য দিতেন। তিনি যখন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন, তখন একই সঙ্গে সহসভানেত্রী পদে সম্মত হয়েছিলেন নূরজাহান মুরশিদ এবং নুরুন্নাহার সামাদ। নূরজাহান মুরশিদ আওয়ামী লীগের দলীয় নেত্রী ছিলেন। জোহরা তাজউদ্দীন এবং নুরুন্নাহার সামাদ ছিলেন আওয়ামী লীগের দুজন প্রখ্যাত মন্ত্রী যথাক্রমে তাজউদ্দীন আহমদ এবং আবদুস সামাদ আজাদের সহধর্মিণী। সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা দুজনই দলনিরপেক্ষ নারী অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই এসব ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির বাধা প্রসঙ্গে কথা বলতাম। তাঁরা বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুস সামাদ আজাদ ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের স্ত্রীদের নারী আন্দোলন ও নারী সংগঠনের কাজ বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেননি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভূমিকাকে তাঁরা প্রশংসা করতেন।
তবে একবারের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। ১৯৭২ সালে মঙ্গোলিয়ায় আয়োজিত আফ্রো-এশীয় মহিলা সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে জোহরা তাজউদ্দীন এবং ডা. ফওজিয়া মোসলেম যোগ দিয়েছিলেন। জোহরা তাজউদ্দীন সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন। আন্তর্জাতিক নারী ফেডারেশনের সঙ্গে চীন নারী সংগঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা না থাকায় সম্মেলনে চীনবিরোধী কথা যেন না তোলা হয় সেই বিষয়ে মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে সতর্ক-অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে বলেছিলাম, যদি আপত্তি থাকে তাহলে বক্তব্যটি ডা. ফওজিয়া দেবেন। আমরা বক্তব্য বদলাব না। সরকারের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী চীনের সঙ্গে সৌহার্দ্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছিল তখন। জোহরা তাজউদ্দীন ঢাকায় ফিরে এসে জানালেন, তিনি সুকৌশলে মহিলা পরিষদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
জোহরা আপা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একনিষ্ঠ সহায়ক ছিলেন। ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংগঠনের আন্তরিক সহযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আমন্ত্রণে যখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নারীনেত্রী এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত থেকে; তখন তিনি তাঁদের আপ্যায়নের জন্য, থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সম্মেলন করা, সদস্যদের যাতায়াত ব্যয়, অফিস খরচ, জেলা সফর করার যাবতীয় অর্থ-সাহায্য তহবিল গড়ে তুলতে তিনি সহায়তা করেছেন। সে জন্য তাঁর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি, জানাচ্ছি এবং জানাব।
জোহরা আপার উদ্বিগ্ন আহ্বানে ১৯৭৫ সালের ২, ৩ ও ৪ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা ঢাকার নানা জায়গায় ঘুরেছি। কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার খবর তখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাসের মধ্যে চার নেতার এই হত্যাকাণ্ড দেশকে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে গভীর সংকটে ফেলে।
সে সময় থেকে জোহরা আপাকে ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সবাইকে কাছ থেকে দেখেছি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোহরা আপা বিনা দ্বিধায় যুক্ত হলেন। দলের কান্ডারি হয়ে সেই দুর্যোগের সময়ে জোহরা আপা ১৯৭৭ সালে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্বতা, বিদগ্ধতা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার বিষয়ে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। আজ খুব কম রাজনীতিবিদকেই আমরা তাঁর অনুসারী হিসেবে পাচ্ছি। সে দুঃখ মনে রেখেই জোহরা আপার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
বাবা-মায়ের স্নেহবঞ্চিত রিপি, রিমি, মিমি ও সোহেলের অপূরণীয় শোকের সাগরে আমরাও অশ্রুপাত করছি।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।