ঝরে পড়ার বছর

সিরিয়ায় মা​নবিক বিপর্যয়
সিরিয়ায় মা​নবিক বিপর্যয়

গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে—এ দৃশ্যের ভেতর কেমন একটা বেদনা মেশানো আছে। ঝরা পাতার মতো ঝরে গেল একটা বছর। শিশুর হাত থেকে ছুটে যাওয়া গ্যাস বেলুনের মতো আমাদের জীবন থেকে ফসকে গেল জীবনের এক টুকরো। নক্ষত্ররা যেমন আকাশ থেকে খসে পড়ে দ্রুত মিলিয়ে যায়, সেই রকম দ্রুততায় যেন চলে যায় আমাদের সময়? দ্রুত এবং জট পাকানো। খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ফেসবুক—এসবের পথ ধরে আমাদের ব্যক্তিগত বছরের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে কত চেনা, অচেনা, কাছের, দূর–দূরান্তের মানুষের শঙ্কা, বেদনা, আনন্দ। টিভির পর্দায় দেখি আলেপ্পোর এক নারী তাঁর কোলের শিশুটিকে এক ত্রাণকর্মীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘আমার এ বাচ্চাটাকে আমি এখানে বাঁচাতে পারব না, বোমার আঘাতে ও মরে যাবে যেকোনো দিন। তুমি ওকে নিয়ে যাও, যেখানে খুশি, তোমার কাছে রাখো কিংবা যে কাউকে দিয়ে দাও। ওকে নিয়ে যাও তুমি।’ সেই নারীর কানে নীল পাথরের দুল ছিল। কথা বলার সময় সে দুলটা নড়ছিল ঘন ঘন। তারপর পুরো বছর থেকে থেকে আমার চোখে ভেসে উঠেছে সেই ঘন ঘন নড়তে থাকা নীল কানের দুল। এ বছর সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় পাঁচ লাখে।

মাকাটো ওকামুরার খুব প্রিয় একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটা এখন জাপানের একটা ফ্ল্যাটে একা একা এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়, তার মনিবকে খোঁজে। তার মনিব মাকাটো আর ফিরবে না। এ বছর এক সন্ধ্যায় ফুরফুরে বাতাসে পাস্তা খেতে খেতে মারা গেছে সে, মেরে ফেলা হয়েছে তাকে, তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে তার অচেনা ঢাকা নামের এক শহরে, হলি আর্টিজান নামের এক রেস্তোরাঁয়। আরও অনেকের সঙ্গে তার মৃতদেহ রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিল সারাটা রাত। মানিকগঞ্জের এক যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইতালির ফ্লোরেন্সে। একটা পিৎজা রেস্টুরেন্টে কাজ করত সে। আমাকে জানাল, যেদিন গুলশানে নিহত নয়জন ইতালীয়র লাশ ঢাকা থেকে ইতালিতে পৌঁছাল, সেদিন তার রেস্তোরাঁর মালিক তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করেন। একটা ঘটনার অভিঘাত কোথায় কীভাবে গিয়ে যে পড়ে, তার হিসাব দুরূহ থেকে দুরূহতম এখন। এ বছর আমরা কি অনেক মূল্য দিয়ে আবিষ্কার করলাম দেশের মাটিতেই কারও কারও কল্পনার দেশ হয়ে গেছে অন্য রকম? তাদের কল্পনার সেই দেশে সব জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। সে দেশে থাকবে শুধু একটি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিরীহ ব্যক্তিদের রক্তের বন্যা বইয়ে। তাদের এই বিশ্বাসেরই সহযোগীরা বার্লিনে ট্রাকের চাপায় পিষে মারে সেই নারীকে, যিনি মেলায় এসেছিলেন তাঁর মেয়ের জন্য একটা সান্তা ক্লজের পুতুল কিনতে।

আবার রুশ দেশের মাস্ত্রোয়েস্কা পুতুলের ওপরটা খুললে যেমন দেখা যায় ভেতরে আরেকটা পুতুল, সেটা খুললে দেখা যায় তারও ভেতর আরেকটা, তেমন একটা ঘটনার ভেতর তো ঢুকে আছে আরেক ঘটনা, একটা বছরের ভেতর ঢুকে আছে আরেকটা বছর। পৃথিবী এখন আইএস–আতঙ্কে কাবু। কিন্তু মাস্ত্রোয়েস্কা পুতুলের মতো আইএসের ঢাকনা খুললে দেখা যাবে আল-কায়েদা, আল-কায়েদার ঢাকনা খুললে দেখা যাবে তালেবান, তালেবানের ঢাকনা খুললে দেখা যাবে আমেরিকা। দোকান থেকে একটা কাচের ফুলদানি কিনে এনে ঘরে রাখি। ফুলদানিটা মোড়ানো ছিল যে সংবাদপত্রের কাগজে, সেটা মাটি থেকে তুলে দেখি, তাতে এ বছরের সেই সংবাদ—গণহত্যার অস্ত্র আছে ভেবে ইরাকে যে আক্রমণ চালিয়েছিল ব্রিটেন আর আমেরিকা, দীর্ঘ তদন্ত শেষে স্বতন্ত্র তদন্ত দল প্রমাণ করেছে যে এ অভিযোগ ছিল পুরোটাই ভুয়া। এ খবরে এখনো শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা সাপ নেমে যায়। বড় ক্ষমতাবান দেশগুলো মিলে বসে নিজেদের স্বার্থে কেমন ঠান্ডা মাথায় তছনছ করে দিতে পারে পৃথিবী। পৃথিবীর মানচিত্রকে লন্ডভন্ড করার অন্যতম কুশীলব ব্রিটেন এ বছর হাত গুটিয়ে নিয়ে বলছে, আমি আর খেলাতে নাই, আমি ব্রেক্সিট।

ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জিততে আর মাত্র ৩৩টা রান বাকি। পরদিন যখন ঢাকায় খেলা শুরু হবে, তখন ব্রিটেনে রাত তিনটা। ব্রিটেনে ৪০ বছর আছেন এক বাঙালি ডাক্তার, থাকেন উত্তর ইংল্যান্ডের এক গ্রামে। বলছিলেন বাংলাদেশ ওই ৩৩ রান করতে পারবে কি না—এই উদ্বেগে তিনি ঘুমাতে পারেননি সারা রাত। ইংল্যান্ডের হিম এক গ্রামে ফায়ার প্লেস জ্বালিয়ে রাত তিনটায় সেই বাংলাদেশি এসে বসেছেন টিভির সামনে। ক্রিকেট এ বছর দেশে-বিদেশে এমনি বহু বাংলাদেশিকে দিয়েছে রাত জাগার সুখ মেশানো উদ্বেগ।

এ বছরই কালভার্টের পাশে মেয়ের এক পাটি স্যান্ডেল পেয়েছেন তার বাবা। কিছুদূর গিয়ে পেলেন মেয়ের মৃতদেহ। এলাকাটি ছিল দেশের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর একটি। সেই নিরাপদ স্থানে কে হত্যা করল তাঁর মায়াবী মেয়ে তনুকে? দিন গেল, সপ্তাহ গেল, বছর ঘুরে গেল—জানা গেল না সেই খবর। সেই এক পাটি স্যান্ডেল কি সংরক্ষণ করে রেখেছেন তার মা? একটা খুব চাপা ক্ষোভ তুষের আগুনের মতো জ্বলে রইল মানুষের মনে। মানুষের মনে এ বছর একটা খুব গভীর বেদনাও জেগে রইল অরণ্যের হরিণের জন্য। আমাদের ঘরে আলো প্রয়োজন; কিন্তু সারা বছর এত আবেদন, নিবেদন সত্ত্বেও সুন্দরবনের গা আরেকটু বাঁচিয়ে কেন বিদ্যুতের এই আয়োজন করা যাবে না, সেই যুক্তি বোধগম্য হলো না।

ময়মনসিংহের এক গ্রামে রাস্তার পাশে ছাগলের দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে এ বছরের সেই সময়, যখন জেল গেটে প্রস্তুত অ্যাম্বুলেন্স। তিনি বলছিলেন, ‘ভাবি নাই কোনো দিন। বিশ্বাস হয় নাই হবে। কী ক্ষমতাবান মানুষ এরা। বাংলাদেশ চায় নাই এরা, তারপরও বাংলাদেশে কী ক্ষমতাবান ছিল এরা। ভাবি নাই কোনো দিন, এরা জেলে যাবে, এদের বিচার হবে, শাস্তি হবে। কী দাপট এদের। তারপরও তো শাস্তি হইল। দেখলাম তো।’ এ বছর বাংলাদেশের মানুষের সেই আস্থা দৃঢ় হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা, ব্যাপারটা নিয়ে টালবাহানা করার দিন শেষ হয়েছে।

প্লেন দেরি হওয়াতে বসে ছিলাম হিথরো এয়ারপোর্টে। কথা হচ্ছিল রুশ দেশীয় এক প্রৌঢ়ার সঙ্গে। জানেন বাংলাদেশের ধানের কথা, যমুনা নদীর কথা। যাননি কখনো বাংলাদেশে। বললেন, মস্কোর কাছাকাছি একটা গ্রামের স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা ছিলেন, তাই পৃথিবীর অনেক খবরই জানেন। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চাকরি চলে যায় তাঁর। দুর্বিষহ বেকারত্ব আর দারিদ্র্যে পড়েন। তারপর নানা ঘোরা পথে এখন ব্রিটেনের এক ক্যাসলের ৫০টি ঘরের মেঝে পরিষ্কার করেন। বলছিলেন, ‘লাঠির আগায় লাগানো কাপড় ভিজিয়ে ভিজিয়ে এতগুলো ঘর মুছতে মুছতে এখন আমি শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওপরে তাকানো যেন ভুলে গেছি।’ নাম জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘আমার নামটা সহজে বলি না, নাম আমার নাতাশা, রুশ দেশের খুব পরিচিত নাম; কিন্তু রাশিয়ার বাইরে এই নামের এখন অন্য রকম অর্থ দাঁড়িয়েছে। অনেক দেশে নাতাশা এখন গণিকার প্রতিশব্দ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দারিদ্র্য রুশ তরুণীদের নিয়ে গেছে পৃথিবীর নানা দেশে এবং যুক্ত করেছে সবচেয়ে সহজ এই পেশায়।’

বলি, ‘একজন সাবেক কমিউনিস্টর পার্টির সদস্য হিসেবে অদ্ভুত লাগে না ব্যাপারটা, কষ্ট হয় না?’ তিনি বলেন, ‘সোভিয়েতের ভাঙা তো অনেক জটিল ব্যাপার, আছে ভেতরের কারণ, বাইরের কারণ। তবে জানেন কি, কমিউনিস্টরা একটু সরল টাইপের মানুষ। তারা আইডিয়ার ঘোরে পড়ে। মানুষ এবং বাস্তবতা ঠিক বুঝতে পারে না ভালো। বাস্তবতা তো ভীষণ ঘোড়েল ব্যাপার। কমিউনিস্টরা বুঝতে পারেনি, চায়নি। দেখুন, এ বছরের সবচেয়ে জাদুবাস্তব ঘটনা ট্রাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া। শ্রমজীবী মানুষই কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভোট দিয়েছে। কী মজার ব্যাপার দেখুন, রাশিয়ার পুতিন হতে চলেছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। জানেন তো, কথিত কমিউনিস্ট দেশ চীন এখন আফ্রিকার হাজার হাজার একর জমি কিনে রীতিমতো উপনিবেশ গড়ে বসেছে। তারা কিন্তু সৌদি আরবেও অস্ত্র বিক্রি করে, যে অস্ত্র সৌদিরা ব্যবহার করে ইয়েমেনের মানুষ মারতে। বিশ্ববাস্তবতা এখন অনেক তালগোল পাকানো। সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত চেনা এত সহজ নয়। পৃথিবী থেকে বৈষম্য দূর করার স্বপ্ন তো দেখতেই হবে আমাদের। কিন্তু সরল অঙ্কে হবে না। নতুন পথ খুঁজতে হবে।’ ঘোষণা হয় প্লেনের বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে গেছে। বিদায় জানাই প্রাসাদের মেঝে পরিষ্কারে নিপুণা সাম্যের স্বপ্ন দেখা নাতাশাকে।

আমার বাবার কবরের পাশে যাই এ বছর। এই তো সেদিনও বাবা গাইত ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর তারার মতো জ্বলে...’। এ বছর বাবা মাটির নিচে কতগুলো হাড় মাত্র। নিঃসঙ্গ মা অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটে, মোবাইলে বোতাম টিপে পৃথিবীর দূর প্রান্তে থাকা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। আমি সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেকে শেখাই কী করে মুখে সাবান লাগিয়ে দাড়ি কামাতে হয়। স্ত্রীকে বলি, চলো, আগামী বছর আমরা আবার অচেনা হওয়ার ভান করি, খুঁজে ফিরি একে অপরকে চুরি করে দেখার সেই সব দিন। আমাদের বয়স বাড়ে, সবকিছু যেতে থাকে নশ্বরতার দিকে। ভাবি, ‘এমন মানব জনম আর কী হবে, মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।’

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক