পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ভাবনা

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী কমিশন গঠন নিয়ে আলাপ হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও আওয়ামী লীগ মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নানা প্রস্তাব ও আইনের পরামর্শও রয়েছে। এগুলো সবই অত্যন্ত ইতিবাচক অগ্রগতি। তবে যুগ যুগ ধরে আমরা দেখেছি নির্বাচনের ফলাফল অনুকূল না হলেই আমরা নানা কারসাজির কথা
শুনে থাকি। রাষ্ট্রপতি একজন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক, তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও প্রশংসনীয়। তারপরও তিনি দীর্ঘদিন একটি দলের রাজনীতি করেছেন। নানা দলের নানা প্রস্তাব আমলে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে সবার কাছে তা যে গ্রহণযোগ্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এমনকি যদি ইসি গঠনের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়, সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে গেলে তার আকার কী হবে, কিংবা সেই সার্চ কমিটি সবার কথা রাখতে পারবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
গত সব নির্বাচন নিয়েই বিজিত দলের অভিযোগের শেষ নেই। দেশের বৃহত্তম দল দুটির প্রতি ভোটারদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। সুতরাং কোনো দলকেই ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যার বিচারে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যান কোনো দলই যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকবে, এ রকম গ্যারান্টি দিতে পারে না, যেমনটি এমনকি মার্কিন মুলুকেও হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলকে ভাবতে হবে, তারা

>গণতন্ত্র সুসংহত এবং শক্তিশালী করতে যেমন শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন, একইভাবে প্রয়োজন নির্বাচনের সময়ে শক্তিশালী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন

যদি কখনো ক্ষমতা হারায়, তাহলে বর্তমানের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন কিংবা নির্বাচনের সময়ে সরকারের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি আছে কি না।
গণতন্ত্র সুসংহত এবং শক্তিশালী করতে যেমন শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন, একই ভাবে প্রয়োজন নির্বাচনের সময়ে শক্তিশালী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন। বিগত বছরগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন কী রকম হবে কিংবা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে সব ক্ষমতার উৎস জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না, এমনকি তারা জানতেও পারেনি তা কীভাবে তৈরি হলো, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সুতরাং জনগণের কিছুটা অংশগ্রহণে কীভাবে এই কাজটি আমরা করতে পারি, তার একটি পুরোনো প্রস্তাব তুলে ধরছি।
পূর্বনির্ধারিত সময়ে দেশবাসী তাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন করার পদ্ধতি উপভোগ করার জন্য টিভির সামনে উপস্থিত হবে। শুধু টেলিভিশন নয়, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সবার সামনে উন্মুক্ত থাকবে। সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিদল তাদের পছন্দসই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নামের তালিকা গ্রহণযোগ্যতার নিম্নক্রমে সাজিয়ে পেনড্রাইভ নিয়ে টিভি পর্দায় উপস্থিত হবে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকতে পারেন। একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে উভয় তালিকা থেকে প্রথম ১০ জনের (অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য সংখ্যাও হতে পারে) মধ্যে কোনো নাম মিলে গেলে বিষয়টি সঞ্চালক দেশবাসীকে জানাবে, না মিললেও তা জানিয়ে দেবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে পেনড্রাইভের নামের তালিকা কিন্তু সব সময়ই গোপন থাকবে। দুই দলের তালিকায় মিল থাকা কিংবা না থাকা নিয়ে দেশবাসী তাঁদের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারবেন। এ জন্য তাঁরা টেলিফোন, এসএমএস, ই-মেইল কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করবেন। সঞ্চালক এভাবে প্রাপ্ত মন্তব্যসমূহ সবাইকে পড়ে শোনাবেন।
এরপর প্রথম ২০, প্রথম ৪০ জনের মধ্যে মিল খোঁজা হবে। এবং আগের মতো দেশবাসীর অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে উপভোগ্য একটি টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ সবাইকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়ে সুসম্পন্ন করা যেতে পারে।
যেহেতু উভয় দলই জানবে যে নামের মিল না থাকলে তাদের দীর্ঘ সময় টিভি প্রোগ্রামে থাকতে হবে এবং জনগণের প্রিয়-অপ্রিয় প্রতিক্রিয়া শুনতে হবে, সুতরাং আশা করা যায় এই প্রক্রিয়ায় যুক্তিসম্মত সময়ের মধ্যেই উভয় পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচিত হবে এবং তা জনগণের সামনে। সুতরাং সেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনকালীন কার্যকলাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ বিরূপ মন্তব্য খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, দেশবাসী জানবে ওই নামটি উভয় দলের তালিকাতে ছিল।
প্রয়োজনে এই পদ্ধতিকে সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধ করে আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ এমনকি নির্বাচন কমিশনার কিংবা প্রয়োজনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনও করা যেতে পারে। দেশের প্রয়োজনে, জাতির স্বার্থে আমাদের সংবিধানের অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন হলে আবারও করা যাবে।
পদ্ধতিটিকে কার্যকর করার জন্য এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে বিস্তারিতভাবে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর একটি জাতির জন্য তথ্যপ্রযুক্তির এমন ব্যবহার নিশ্চয়ই আশার সঞ্চার করবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।