প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে! কী করব?

ধরা যাক, আপনার সন্তান কোনো পাবলিক পরীক্ষা দিচ্ছে। সেটা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হতে পারে, জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষা হতে পারে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হতে পারে। শিক্ষার্থীটির কাল বা পরশু পরীক্ষা। আজ রাতে আপনি শুনলেন, পরের বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফেসবুকে সেই প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে। অথবা বাজারে গেলে সেই প্রশ্নপত্রের ফটোকপি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে, সুলভে কিংবা উচ্চমূল্যে। এই সময় আপনি কী করবেন? মা বা বাবা হিসেবে? অভিভাবক হিসেবে?
আচ্ছা, ধরা যাক, পরীক্ষা দিচ্ছ তুমি। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা। পরীক্ষা আগামীকাল। সাধারণ গণিত। আজ সন্ধ্যায় তুমি শুনতে পেলে প্রশ্নপত্র ‘আউট’ হয়ে গেছে। তোমার বন্ধুরা তোমাকে ফোন করছে। কেউ বলছে, ফেসবুকে ঢোক, প্রশ্নপত্র দেখে নে। কেউ বলছে, ‘আমার কাছে ফটোকপি আছে, তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ তাহলে তুমি কী করবে?
আমি কিশোর-তরুণদের জন্য একটা কল্পকাহিনি লিখেছি এবার। বইটির নাম এক লক্ষ লাইক। সেখানেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। শান্তা নামের একটা মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। আগের রাতে সে মন দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎই ফোন: ‘এই, কোশ্চেন তো আউট হয়ে গেছে। যা, ফেসবুক খোল।’ তার ‘চালাক মামা’ আসেন একটু পরে, তাঁর হাতে তথাকথিত প্রশ্নপত্রের কপি।
এখন আমার কাল্পনিক চরিত্র শান্তা কী করবে?
এটা বলার আগে বলে নিই, একই পরিস্থিতিতে কী করেছিল রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজের ছাত্রী সুমাইয়া। সুমাইয়া বিনতে আফসার আমাকে ২০১৪ সালে বলেছিল:
‘আমি জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছি। বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার সময় শোনা গেল, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমার কোনোই ইচ্ছা নেই যে আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখব। বিজ্ঞান পরীক্ষার আগে জোর গুজব, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমি সেসবে কান না দিয়ে বাসায় নিজের মতো করে পড়ছি। বন্ধুবান্ধব প্রশ্নপত্রের কপি নিয়ে বাসায় চলে এল। সবাই বলাবলি করতে লাগল, প্রশ্নপত্রটা একবার দেখে নেওয়া উচিত। বাসারও কারও কারও একই মত। আমি আমার ভাইয়া ও আম্মুকে স্পষ্ট বলে দিলাম, আমি প্রশ্নপত্র দেখব না। তাঁদের মুখ দেখে মনে হলো, তাঁরাও চান আমি প্রশ্নপত্র দেখি। আমি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিজের মতো প্রস্তুতি নিলাম। পরের দিন পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষা ভালো হলো। পরে আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে আসল প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখলাম। কিছুই মেলেনি। পরীক্ষা আমার ভালো হয়েছিল। আমার সততার পুরস্কার আমি পেয়েছি। আমি উত্তরা থানার মধ্যে পঞ্চম হয়ে বৃত্তি পেয়েছি।’
সুমাইয়া বিনতে আফসার যা করেছিল, শ্রদ্ধেয় অভিভাবক, তা থেকে শিক্ষা নিন। সুমাইয়া বিনতে আফসার যা করেছিল, প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমরাও ঠিক এই কাজটাই করবে।
আমার কাল্পনিক লেখা এক লক্ষ লাইক-এ শান্তা নামের এসএসসি পরীক্ষার্থিনীও তা-ই করেছে। সে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে বলেছে, প্রশ্নপত্র আউট হোক, আর না হোক, আমি তা দেখব না। আমি যা প্রস্তুতি নিয়েছি, তাই সম্বল করে পরীক্ষার হলে যাব। তাতে আমার ফল যা হয় তা-ই হবে। আমার গল্পে দেখা গেল, প্রশ্নপত্রের নামে যা বেরিয়েছিল, তার বেশির ভাগই ছিল ভুয়া। কাজেই ওই সব প্রশ্ন পেয়ে ফাঁকিবাজির প্রস্তুতি নিয়ে যারা গিয়েছিল হলে, তাদের পরীক্ষা হলো ভীষণ খারাপ।
কিন্তু বাস্তবে সব সময় যে ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়ায় তা-ও তো নয়। মাঝেমধ্যেই তো আমরা দেখছি, আসলেই পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। আগের বছরগুলোতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা এই অভিযোগ সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এবার শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আদৌ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি না, নাকি এটা ভুয়া প্রশ্নপত্র, হয়ে থাকলে কোন অঞ্চলে হয়েছে, তার প্রভাব সার্বিক পরীক্ষার ওপরে কতটা পড়েছে, সবটা দেখে আমরা ব্যবস্থা নেব। যদি দেখা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে মারাত্মক, পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হবে।
এটা অবশ্যই একধাপ অগ্রগতি। তিনি অন্তত তদন্ত করে দেখতে চেয়েছেন।
এখন আবারও প্রথম প্রশ্নটাতে যাই। যদি আমার ছেলেমেয়ে পরীক্ষার্থী হয়, আর আমি জানতে পারি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, ইচ্ছা করলে তার কপি জোগাড় করা যাবে, তখন আমি কী করব?
যদি আমিই পরীক্ষার্থী হই, একই রকম পরিস্থিতিতে আমি কী করব?
এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। আমি আবারও বলছি, বিকল্পহীনভাবে এই প্রশ্নের একটাই উত্তর। আমরা বিচলিত হব না। কারও কথায় কান দেব না। যেন এই ধরনের কোনো কথা শুনিনি। যেন এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র দেখব না, তা জোগাড় করার চেষ্টা করব না, কেউ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেও সেটার দিকে আমি তাকাব না। আমি নিজের মতো করে প্রস্তুতি নেব। আমার পরীক্ষা ভালো হবে বা খারাপ হবে। আমার বন্ধুরা যারা প্রশ্নপত্র পেয়েছে, তাদের ফল আমার চেয়ে অনেক ভালো হতে পারে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, যে বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চেয়েছিলাম, তাতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হারাতে পারি। আমার চেয়ে অযোগ্য কেউ অসদুপায় অবলম্বন করে সেই সুযোগ বাগিয়ে নিতে পারে। তাতে কী?
আমি বলি, পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জীবনের ফলের কোনো সম্পর্ক নেই। ভালো বিষয়, খারাপ বিষয় বলতে কিছু নেই। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বক্তৃতায় বলেন, সাকিব আল হাসানকে কি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনি জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন কি না? সংগীতশিল্পী মমতাজকে কি কেউ জিজ্ঞেস করে আপনি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন কি না? আমরা তো আসাদুজ্জামান নূরের নামই বলতে পারি; মাননীয় মন্ত্রী, আপনি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন কি না? আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমার পিতা ও মাতা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু আমি পড়াশোনায় তত মনোযোগী ছিলাম না, ভালো ছাত্র ছিলাম না, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন করেছি।’
আজকে যদি পৃথিবীর দিকে তাকাই, বাংলাদেশের দিকে তাকাই, যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই পরীক্ষার ফলের কোনো সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ স্কুল পাস করতে পারেননি, নজরুল পারেননি, আইনস্টাইন কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। এই উদাহরণ দিলে বলা হতে পারে, আরে আগেকার আমলের কথা বাদ দিন, এখনকার আমলের কথা বলেন। আচ্ছা, বিল গেটসের উক্তি ইন্টারনেটে প্রচলিত আছে, বিল গেটস বলেছেন, ‘আমি হার্ভার্ডে তিনটা বিষয়ে ফেল করেছিলাম, আমার এক বন্ধু সব পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল, আমার সেই বন্ধুটি এখন মাইক্রোসফটে আমার প্রতিষ্ঠানে সফট ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করে।’
বিল গেটস তো এখন পৃথিবীর এক নম্বর ধনী, এক নম্বর কম্পিউটারবিদ এবং এক নম্বর দানশীল সমাজসেবক। নিজের অর্থসম্পদের প্রায় পুরোটাই মানবকল্যাণে দান করে দিয়েছেন।
আমি রসিকতা করে একটা কথা বলি। এটাকে রসিকতা হিসেবেই না-হয় নিন। ‘আপনি যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট হন, আপনি প্রকৌশলী হবেন, আর আপনি যদি পরীক্ষায় খারাপ করেন, ওই প্রকৌশলীর চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানটির আপনি মালিক হতে পারেন। আপনি যদি ভালো ছাত্র হন, আপনি ডাক্তার হবেন, আর আপনি যদি খারাপ ছাত্র হন, তাহলে আপনি একটা হাসপাতালের মালিক হতে পারেন। আপনি যদি ভালো ছাত্র হন, আপনি সচিব হবেন, আর আপনি যদি খারাপ ছাত্র হন, আপনি মন্ত্রী হতে পারেন।’
তবে, আমাদের ভালো ছাত্রের দরকার আছে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, যিনি ভাইল ফার্মিয়ন কণা আবিষ্কার করে দুনিয়াতে হইচই ফেলে দিয়েছেন, সেই জাহিদ হাসান এসএসসিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন, এইচএসসিতে হয়েছিলেন বোর্ডের মধ্যে প্রথম। হুমায়ূন আহমেদ বোর্ডের পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন।
কিন্তু পরীক্ষার ফলই সবকিছু নয়। আমার তো মনে হয়, কিছুই নয়। আসলে দরকার শিক্ষা। আসলে দরকার জ্ঞান। আসলে দরকার দক্ষতা। আসলে দরকার সততা ও উচ্চতর মূল্যবোধ। আসলে দরকার নেতৃত্বের গুণ, দেশপ্রেম, সাংগঠনিক ক্ষমতা। পরীক্ষার ফল কিছুই দেয় না।
আবারও এ পি জে আবদুল কালামের উদাহরণটা দিই। তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। দেরাদুনে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, অকৃতকার্য হলেন, নদীর ধারে বসে ভাবছেন, এই জীবন রেখে কী লাভ। একজন সাধু তাঁকে বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে?’ এ পি জে আবদুল কালাম ঘটনা খুলে বললেন। সাধু তাঁকে বললেন, ‘নিয়তি তোমাকে হয়তো পাইলট হওয়ার জন্য ঠিক করে রাখেনি, তোমার জন্য হয়তো অন্য কিছু অপেক্ষা করছে। তুমি সেটা খুঁজে নাও।’ এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন হয়েছিলেন; পরে হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। কাজেই ডাক্তারি না পড়লে আমি শেষ, ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়লে জীবনই বৃথা—এই সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পারসি সাহিত্য নিয়ে পড়ো, সেরা পারসি সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দাও। পালি পড়ো, আমাদের জানাও ওতে কী মণিমাণিক্য রয়েছে। উদ্যোক্তা হও, আমাদের চাকরি দাও, সেবা দাও। নেতা হও, বাংলাদেশকে এগিয়ে নাও। ভালো মানুষ হও, সুন্দর মানুষ হও।
এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডকে বলি। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শ শুনুন। ১০ সেট প্রশ্নপত্র বানিয়ে রাখুন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপানো, বিতরণ—শিকলটা অনেক বড়, এই দুর্নীতির ইঁদুরদৌড়ে শামিল দেশে এই শিকল যেকোনো জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কাজেই ১০ সেট প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দিয়ে পরীক্ষার আধঘণ্টা আগে জানিয়ে দিন কোন সেটে পরীক্ষা হবে।
জীবনটা ১০০ মিটার দৌড় নয়। এটা ম্যারাথন। দুর্নীতিবাজেরা প্রথম ১০০ মিটারে এগিয়ে থাকতে পারে, ১০-২০ মাইল দূরে তাদের জন্য সোনার মেডেল অপেক্ষা করছে না। সৎ মানুষ যদি নিজের অন্তরে আলো জ্বালাতে পারেন, জীবন তাঁকেই সোনার মেডেল দেবে শেষ পর্যন্ত। তিনি আলোকিত হবেন, আমাদেরও আলোকিত করবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।