এর নাম বইমেলা!

চট্টগ্রামে ডিসি হিল থেকে শহীদ মিনার এলাকার দূরত্ব পাঁচ শ গজেরও কম। কিন্তু এইটুকু দূরত্বে দু-দুটি বইমেলার আয়োজন করা হলো। একটির আয়োজক একুশ মেলা পরিষদ নামের একটি সংগঠন, যার পেছনে আছেন সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কাউন্সিলর। করপোরেশনের একজন প্যানেল মেয়র ছিলেন এই মেলার উদ্বোধক। অন্যটি সিটি করপোরেশনের আয়োজন। স্বয়ং মেয়র উদ্বোধন করছেন এই বইমেলাটি। পাঠক বিভ্রান্ত। কোনটি আসল বইমেলা? দুটিরই দীনহীন অবস্থা। ডিসি হিলের মেলাটিকে কেন ‘একুশের বইমেলা’ নামকরণ করা হলো বোধগম্য নয়। কারণ, কিছু পুস্তক বিক্রেতা (প্রকাশনা সংস্থা নয়) পসরা সাজিয়ে বসলেও চারপাশে নাগরদোলা থেকে মণ্ডা মিঠাই পর্যন্ত বিক্রির আয়োজন এটিকে গ্রাম্য মেলার চেহারা দিয়েছে। এই উদ্যোক্তাদের বইমেলার পরিবেশ ও মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা দেবে সাধ্য কার!
শহীদ মিনারসংলগ্ন এলাকার অবস্থা তুলনামূলক ভালো। অন্তত স্থানীয় প্রকাশকেরা নিজেদের বই নিয়ে এসেছেন সেখানে। কিন্তু চট্টগ্রামের মতো দেশের বৃহত্তম নগরের একটি বইমেলার আয়োজন যে রকম হওয়ার কথা তার অনেকটাই অনুপস্থিত এখানেও। পর্দা টাঙিয়ে কয়েক সারি দোকান, টেবিলে কিছু বই নিয়ে বসেন দোকানিরা। এসব বই বিপণিতে না আছে সজ্জা বা নান্দনিকতার স্পর্শ, না লেখক-পাঠক-গ্রন্থপ্রেমীদের আকর্ষণ করার ন্যূনতম ব্যবস্থা। মেলা প্রাঙ্গণের মঞ্চে প্রতিদিন নানা রকম অনুষ্ঠান চলতেই থাকে, তাতেও কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। শুধুই কোলাহল। দেশের বাইরের কোনো বইমেলার কথা দূরে থাক ঢাকার বাংলা একাডেমির মেলার সঙ্গে এই বইমেলার তুলনা টেনে চট্টগ্রামের লেখক-পাঠকেরা হতাশায় ভোগেন। একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন বইমেলার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তাঁদের অধরা থেকে যায়।
সারা বছরে অন্তত ৮-১০টি বইমেলার আয়োজন হয় চট্টগ্রামে। জেলা প্রশাসন, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও চট্টগ্রাম একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এসব মেলার আয়োজক। সরকারি সংস্থাগুলোর বইমেলা অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, কখনো জিমনেসিয়ামের সামনের মাঠটিতে, কখনো শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসব মেলার আয়োজনে জনসমাগম তেমন হয় না বললেই চলে। কেননা, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিবার একই নিয়মে এসব মেলার আয়োজন হয় না বলে এর কোনো ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠেনি।
বেসরকারি আয়োজনের মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রাম একাডেমির ‘স্বাধীনতার বইমেলা’টিকে কিছুটা পরিকল্পিত মনে হলেও বাকিগুলো একেবারেই দায়সারা, অগোছালো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব এলোমেলো আয়োজন না করে, চট্টগ্রামে সুপরিকল্পিত একটি বইমেলা কি করা সম্ভব? বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে (অবশ্যই তা ফেব্রুয়ারি) এবং নির্দিষ্ট স্থানে (শহীদ মিনার ও মুসলিম ইনস্টিটিউটসংলগ্ন চত্বর) বড় ধরনের একটি বড় মেলার আয়োজন করা হলে পাঠক-লেখক-গ্রন্থপ্রেমীরা কি প্রাণের টানে ছুটে আসবেন সেই মেলায়?
এ দুটি প্রশ্নের উত্তরই হচ্ছে ‘হ্যাঁ’। নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলেই আমাদের এই মনে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে, যার যখন যেখানে খুশি যেকোনো অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ হিসেবে ‘বইমেলা’ নামের একটি জগাখিচুড়ির আয়োজন বন্ধ করা। বিশেষ করে জেলা প্রশাসন ডিসি হিলে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি প্রদানের সময় শর্ত জুড়ে দেবে এখানে বইমেলা করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, জেলা প্রশাসন, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, সিটি করপোরেশন প্রভৃতি সব কটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পৃথক উদ্যোগগুলো বন্ধ করে বছরে একটিমাত্র বইমেলার আয়োজন করা। এই কাজটি কঠিন, কিন্তু কাউকে না কাউকে বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধতে হবে। এসব সংস্থা পৃথকভাবে তাদের জন্য বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করে বইমেলা উপলক্ষে। এই অর্থহীন অর্থ ব্যয় বন্ধ করে একটি তহবিল গড়ে তুললে বড় ধরনের একটি বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব।
ভালো আয়োজন হলে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও অংশগ্রহণের যে অভাব হয় না তার বড় দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে আছে। ১৯৮৮ সালে মুসলিম ইনস্টিটিউট ও শহীদ মিনারসংলগ্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে একটি বইমেলার আয়োজন করেছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। সুপরিকল্পিত সেই মেলায় দুই টাকা প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করেছিল আয়োজকেরা। লক্ষাধিক টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল মেলায়। অর্থাৎ পাঠকের আগ্রহ আছে, এমনকি টাকা দিয়ে মেলায় প্রবেশের ব্যাপারেও তাদের আপত্তি নেই। শুধু তাঁদের মনের মতো একটি আয়োজন করতে পারলেই এ ধরনের উদ্যোগের সাফল্যের ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু এত বছরেও ওই রকম একটি উদ্যোগ নিতে পারলাম না আমরা।
সিটি করপোরেশনের ১১ দিনব্যাপী বইমেলার উদ্বোধন করে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, আগামী বছর থেকে বাড়ানো হবে মেলার পরিধি। ঢাকার বইমেলা যেভাবে সারা দেশে আবেদন সৃষ্টি করেছে, তেমনি সিটি করপোরেশনের বইমেলাও যেন সে রকম আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
অর্থাৎ এই মেলার আঙ্গিক বা পরিসর তাঁকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথাও বলেছেন তিনি। তাঁর এই অতৃপ্তি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাই। প্রসঙ্গক্রমে বলি, মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে বইমেলাকে শহীদ মিনার এলাকা থেকে সরিয়ে লালদীঘির মাঠে স্থানান্তর করেছিলেন। তখন এই কলামে লিখেছিলাম, ‘বইমেলা আর বলীখেলা এক নয়।’ তিনি হয়তো আমাদের বক্তব্য অনুধাবন করতে পারেননি। এখন বর্তমান মেয়রের উদ্দেশে সবিনয়ে বলি, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে আর যা-ই হোক, তাঁর ভাষায় ‘আবেদন’ সৃষ্টি করার মতো বইমেলার পরিকল্পনা বা আয়োজন করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রামের লেখক-প্রকাশক-বুদ্ধিজীবীদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত না করলে, তাঁদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন না করলে প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না।
অনেকেই বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে বইমেলা করলে ঢাকার প্রকাশকেরা তাতে অংশগ্রহণ করবেন না। কারণ, তাঁরা একই সময়ে ঢাকায় বইমেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এই যুক্তিটি আমাদের গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বই বিক্রির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারলে বড় প্রকাশকেরা তাঁদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে এখানকার মেলায় অংশ নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
পর্দা টাঙিয়ে সারি সারি দোকানের পরিবর্তে বই বিপণিগুলোর দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসজ্জার ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদেরও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বইমেলার মঞ্চে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানালে পুরো আয়োজনটিই অন্য মাত্রা পাবে। মনে রাখতে হবে সবকিছুরই শুরু আছে। একবার এ রকম একটি বড় কিছুর সূচনা হলে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
মেয়র ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আয়োজন করতে পেরেছেন, বইমেলার আয়োজনেও তিনি তাঁর সেই সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবেন—এই বিশ্বাস আমরা রাখতে চাই।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]