মোনায়েমের কেরামতিতে দুই ঘণ্টা 'লম্বা' ভাষণ

আরশাদ সামি খান পাকিস্তানের তিন প্রেসিডেন্টের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও আইয়ুব খানের সঙ্গেই বেশি সময় ছিলেন। তাঁর প্রতি লেখকের যে কিছুটা পক্ষপাত আছে, তা তিনি গোপন করেননি। তিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে তাঁর কাছে আইয়ুবকেই ‘উত্তম’ মনে হয়েছে। কিন্তু সেই ‘উত্তম’ প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের জনপ্রিয়তায় এতটাই সন্ত্রস্ত ছিলেন যে তিনি কিছু আজগুবি অভিযোগ এনে তাঁকে সরিয়ে দেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ময়মনসিংহের উকিল নামে পরিচিত আবদুল মোনায়েম খান। এর আগে অবশ্য তিনি আইয়ুবের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। আইয়ুবও স্বীকার করেছেন, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও উচ্চতর প্রশাসন সম্পর্কে লোকটির কোনো ধারণা নেই। তারপরও কেন তাঁকে গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছে? অপরিসীম আনুগত্য। যোগ্যতার ঘাটতি তিনি আনুগত্য দিয়ে পুষিয়ে নিয়েছেন।

সামি খান পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিক ও সামরিক-বেসামরিক আমলার চারিত্রিক দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন, যার সবটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে তাঁর বইয়ে মোনায়েম খান সম্পর্কে যেসব মজার তথ্য ও ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, তা যেকোনো কৌতুক–নাটকের উৎকৃষ্ট চরিত্র হতে পারে। এখানে একটি ঘটনা তুলে ধরছি।

আবদুল মোনায়েম খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়া নিয়ে গভর্নর ভবনের কর্মীদের মধ্যে যে কৌতুকটি চালু ছিল, তা এ রকম: একদিন ‘শুভক্ষণে’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ঘোষণা করলেন, ঢাকার পুবদিকের ফটক দিয়ে আগামীকাল সকালে যে ‘খাঁটি বাঙালি রক্তের’ ব্যক্তিটি ঢাকায় প্রথম ঢুকবেন, তাঁকেই গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। মোনায়েম খান এমন একটি প্রাণীর (গাধার) পিঠে চড়ে এসেছিলেন, যেটি পূর্ব পাকিস্তানে কদাচিৎ দেখা গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে মালামাল বহনের জন্য প্রায়ই ব্যবহৃত হতো। আর মোনায়েম খান এমনই বিরল বাহনে চড়ে সেদিন সকালে প্রথম ঢাকায় ঢুকলেন এবং আইয়ুবের সব শর্ত মেনেই তিনি গভর্নরের চেয়ারে বসলেন।

আরশাদ সামি খান লিখেছেন, তিনি গভর্নর মোনায়েম খান সম্পর্কে অনেক কৌতুককর ঘটনার কথা শুনেছেন। সেগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা করেননি। নিজের দেখা কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যেহেতু বাংলা বলতে পারেন না, সেহেতু উর্দু কিংবা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেন এবং দলের কোনো নেতা কিংবা মন্ত্রী তা বাংলায় অনুবাদ করেন।

১৯৬৭ সালের মার্চের শুরুতে ময়মনসিংহে আয়োজিত এক জনসভায় আইয়ুব খানের ভাষণ মোনায়েম খান নিজেই ভাষান্তর করবেন বলে তাঁর (প্রেসিডেন্ট) সামরিক সচিবকে অনুরোধ করেন। সেটি ছিল বেশ বড় সমাবেশ। সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে আসামি করায় তা আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের ধারণা হলো, মোনায়েম খান শেখ মুজিব ও ছয় দফা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি, তাঁর ভয়, মানুষ তাতে ক্ষুব্ধ হবে। আইয়ুবের ভাষণ ভাষান্তরের উদ্দেশ্য হলো, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে সেটি লুকানো।

এরপর সামি খান জনসভাস্থলের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘নিরাপত্তার কারণে মঞ্চ অনেক উঁচু করা হয়েছিল এবং জনগণের বসার জায়গা ছিল বেশ দূরে। মঞ্চে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গভর্নর ছাড়াও সাদাপোশাকের নিরাপত্তাকর্মী, ওই এলাকার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট পোডিয়াম থেকে ভাষণ শুরু করলেন। গভর্নর বসে ছিলেন প্রেসিডেন্টের ঠিক পেছনে, যাতে তিনি তাঁর ভাষণ ভাষান্তর করতে পারেন। কিন্তু তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন এবং নাক ডাকতে থাকলেন। মঞ্চে উপবিষ্ট সবাই তাঁর নাকডাকা শুনতে পেলেন। গভর্নর যখন ঘুমাচ্ছিলেন, সামি তাঁর সচিব ক্যাপ্টেন জিলানিকে ডেকে তাঁকে জাগিয়ে দিতে বললেন; না হলে তিনি তো ভাষান্তর করতে পারবেন না। কিন্তু সচিবের জবাব ছিল, ‘চিন্তা করবেন না, আমি নোট নিচ্ছি, যাতে গভর্নর ভাষান্তর করতে পারেন।’

সামি আরও বলেন, ‘আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে গভর্নরের নাকডাকা শুনতে লাগলাম এবং ভাবলাম, তৃতীয় একজনের নোটের ভিত্তিতে তিনি কীভাবে ভাষান্তর করবেন?’ প্রেসিডেন্ট প্রায় এক ঘণ্টা ভাষণ দিলেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের ছয় দফা এবং আরও বেশি দাবিদাওয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়। তিনি জনসমাবেশকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, এসব দাবির উদ্দেশ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল করা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাঙন ধরানো, যা ভারতের উদ্দেশ্য।

যখন প্রেসিডেন্ট ভাষণ শেষ করলেন, তখন সচিব দ্রুত গিয়ে তাঁর বসের ঘুম ভাঙালেন। গভর্নর দীর্ঘ হাই তুললেন এবং সচিবকে নোটগুলো পোডিয়ামেরাখতে বললেন। এরপর গভর্নর প্রেসিডেন্টের কাছে ভাষণ অনুবাদ করার অনুমতি চাইলেন। তিনি ভাষণ শুরু করলেন কোরআনের আয়াত পাঠ দিয়ে, যদিও প্রেসিডেন্টের ভাষণে তা ছিল না। এরপর তিনি প্রেসিডেন্টের এক ঘণ্টার ভাষণের ভাষান্তর করতে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেন। দ্রুতগতির ট্রেনের মতো তিনি কোথাও থামলেন না। হিটলার যেভাবে নাজিদের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন, গভর্নরও সেভাবে কখনো গলার স্বর উচ্চগ্রামে, কখনো নিম্নগ্রামে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ, গালিব ও ইকবালের কবিতা থেকে আবৃত্তি করলেন, যা প্রেসিডেন্ট বলেননি। এটি ছিল একবারেই নজিরবিহীন ঘটনা।

বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে প্রেসিডেন্ট তাঁর পাশে বসা গভর্নরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মোনায়েম সাব, আমি তো অত বড় বক্তৃতা দিইনি। আপনি যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করলেন, আমি সেসব বলিনি। এমনকি টেগরের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কোনো কবিতাই আমি পড়িনি। আপনার ভাষান্তরে এসব এল কীভাবে?’

মোনায়েম খান হাসলেন এবং বললেন, ‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনি কী বলেছেন আর আমি কী যোগ করেছি, সেটি বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণ তা শুনতে চেয়েছে। আপনি কি লক্ষ করেননি, আমি যখন গান গাইছিলাম, তখন তারাও গান গাইছিল। আমি যখন হাসছিলাম, তখন তারাও হাসছিল। দূরদূরান্ত থেকে আসা এই মানুষগুলো আপনার বা আমার বক্তৃতা শুনতে চায়নি। তারা এসেছে আনন্দের জন্য, স্যার। তাদের একঘেয়ে জীবনে আনন্দের প্রয়োজন আছে। এ কারণেই তারা যৌনতার প্রতি বেশি আকৃষ্ট, বিশেষ করে যখন যৌনতা ছাড়া তাদের কিছু করার থাকে না। আপনি দেশব্যাপী যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছেন, তারপরও জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে। তারা এসব কেন্দ্রে যায় বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী নিতে নয়, এটির ব্যবহারবিধি শুনে যৌনানন্দ পাওয়ার জন্য।’

এরপর সামি খান লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব, যাঁকে আমি অত্যন্ত উঁচু রুচির ও গুরুগম্ভীর মানুষ বলে মনে করি, হঠাৎই তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সামনের আসনে বসা আমার পক্ষেও হাসি সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ল।’

সামি খান আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেখানে বিমানন্দরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে অভ্যর্থনা উপলক্ষে সড়কে সব ধরনের যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেখানো হয়েছিল প্রেসিডেন্ট কত জনপ্রিয়। সেদিন আইয়ুবের এডিসি সামি খান তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েও ঠিক সময় পৌঁছাতে পারেননি। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মোনায়েম খান বলেন, ভবিষ্যতে তাঁকে যেন আগেভাগে জানানো হয়। তাহলে গভর্নর তাঁর সহায়তায় আরও বেশি নিরাপত্তা বাহন দিতে পারবেন। এ কথা শুনে সামি হাসছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা বলছিলেন; আর গভর্নর ভাবছেন প্রটোকলের কথা!

ভাবা যায়, এই চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন পূর্ববঙ্গের গভর্নর, তাও স্বল্প সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘ ছয় বছর। এই মোনায়েম খানই নাকি বলেছিলেন, তিনি গভর্নর থাকতে শেখ মুজিব জেলখানা থেকে মুক্তি পাবেন না। আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফার জবাব দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো উনসত্তরে শেখ মুজিব জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েক দিনের মাথায় মোনায়েম ও তাঁর নিয়োগকর্তা দৃশ্যপট থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। আইয়ুব প্রথমে মোনায়েম খানকে সরিয়ে ড. এম এন হুদাকে গভর্নর করেন। পরে তাঁকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

আর শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হন।

আগামীকাল: নির্বাচনের ফল দেখেই বিচলিত ইয়াহিয়া

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।