জোহরা তাজউদ্দীনের উত্তরাধিকার

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন

দেশ যখন একটি বিরাট রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে, তখন আমরা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে হারানোর অপূরণীয় ক্ষতি অনুভব করছি। আমাদের ইতিহাসের কতিপয় উল্লেখযোগ্য সংকট উত্তরণে আমরা তাঁর ইতিবাচক ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করি। তিনি সংকটকালে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও নভেম্বরে জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড আমাদের রাজনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত করেছে এবং রাজনীতির প্রতি যে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করেছিলাম, তা স্মরণ করা আজ প্রাসঙ্গিক। ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় স্বার্থান্বেষী নেতার কীর্তিকলাপে আমরা যখন বিস্মিত ও ব্যথিত ছিলাম, তখন জনগণের ক্ষমতায় দৃঢ় আস্থা রেখে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। তিনি জনতার একটি সংগঠনকে সংগঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করলেন, যাতে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে আস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারি।
সুস্থ রাজনীতির প্রতি তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। স্বাধীনতাসংগ্রামকালে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন; যাতে তারা স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠনের হয়ে নিরলসভাবে কাজ করতে পারে। তিনি দেশময় চষে বেড়ান এবং দলের বিভিন্ন উপদলীয় শাখাকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ যাঁদের ঘটেছে, তাঁরা স্মরণ করতে পারবেন যে কীভাবে তিনি তাঁর ন্যায্যতা ও নিরপেক্ষতা দিয়ে তাঁদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। কতিপয় সাময়িক সুবিধা ভোগের জন্য যা পরিষ্কারভাবে ভ্রান্তি, তার সঙ্গে তিনি কখনো আপস করেননি।
ক্ষমতা লাভের জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দুটি ধারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকল। আমরা যা হারিয়েছিলাম, তা পুনরুদ্ধারে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আমাদের ইতিহাসের ওপর নির্ভর করলেন। যে ইতিহাসে জনগণের ক্ষমতার কথা বলা আছে। জনগণের ক্ষমতায়নে তিনি তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করলেন। এর বিপরীতে আমরা বিবেকহীন ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক দেখলাম, যাঁরা ক্ষমতা জবরদখলকারীদের সঙ্গে আপস করলেন। কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও সম্পদের অপব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে। তাদের লক্ষ্য জনগণের ক্ষমতাকে উপেক্ষা ও হেয় করে একটি কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা। এ জন্য তারা মোসাহেবি ও নিপীড়ন চালিয়ে ওপর থেকে সবকিছু চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই ওপর থেকে চাপানো ফন্দিফিকিরই শক্তিশালী হয়েছে।
কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন অন্যতম অবিসংবাদিত নেতা। জনগণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সা ও রগ্ণ রাজনীতি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর পরিবর্তে তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং সর্বোপরি আমাদের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামের ঐতিহাসিক সাফল্যগাথা স্মরণ করিয়ে জনগণকে উৎসাহিত করেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে নাগরিকদের উৎসাহিত করেছেন।
১৯৭৮, ১৯৮১ ও ১৯৮৭ সালের নির্বাচনগুলো কার্যকর গণতন্ত্র নিশ্চিত করেনি। কারণ, সুস্থ রাজনীতির অনুপস্থিতি। আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। জনগণের সঙ্গেই তাদের প্রকৃত সম্পর্ক থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা থাকেনি।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে জোহরা তাজউদ্দীন আমাদের অন্যতম শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দল পুনর্গঠনে তাঁর অসামান্য অবদান স্বীকৃত হয়। এবং দলের সভাপতি পদের জন্য ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম এসেছিল। এটা একটি নিয়তি, কিন্তু তার সঙ্গে মিশেছিল তাঁর প্রজ্ঞা ও নিঃস্বার্থপরতা। তিনি সেদিন তাঁর পরিবর্তে ওই পদের জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যার নাম প্রস্তাব করেছিলেন।
এর পরবর্তী দুই দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি বিচিত্রভাবে এগিয়েছে। তবে উল্লিখিত দুই ধারা পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। সৎ ও সুস্থ রাজনীতি পুনরুজ্জীবনের লড়াইয়ের বিপরীতে অসুস্থ রাজনীতি, কালোটাকা, পেশিশক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্র গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এবং রগ্ণ ধারাটিই ১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে নির্বাচনী জয় পেয়েছে।
১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির কারচুপির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, নারী সংগঠন এবং একই সঙ্গে শ্রমিক, চাষি, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকারকর্মীদের অংশগ্রহণে ঋদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। এবং সম্মিলিতভাবে তারাই সাহসের সঙ্গে স্বৈরতন্ত্র প্রতিহত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু রাজনৈতিক নেতা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ সাংসদ ময়েজউদ্দিন আহমদ, শ্রমিকনেতা তাজুল, ডা. মিলনের মতো পেশাজীবী এবং তারুণ্যের অগ্নিমশাল হয়ে ওঠা নূর হোসেন এবং সেলিম, দেলোয়ার, জয়নাল ও দীপালি সাহার মতো তরুণেরা ছিলেন। তাঁদের আত্মোৎসর্গের কারণে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবন করা সম্ভব হয়েছিল।
আমাদের শহীদদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিকেরা স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করবেন। নাগরিকেরা ধর্মীয়, জাতিগত বা লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কার্যকর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ভোগ করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা সমতা ও সাম্যের নিশ্চয়তা পাবেন।
সমতা ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রকৃত লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। এর কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে যেতে না পেরে শাসক কোটারির খপ্পরে পড়েছে। এই চক্র জনগণের ভাবাবেগের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বলেও তারা কাজে জনগণকে ভাঁওতা দিয়েছে। নিরীহ জনগণের অন্ধ সমর্থন নিয়ে তারা সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনীতিকে রুগ্ণ করে তুলেছে, যা ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে নিরঙ্কুশ করেছে। এরা গণবিরোধী কায়েমি স্বার্থরক্ষার দোসর। এরাই খেতে-খামারে, কলকারখানায়, বিদেশবিভুঁইয়ে লাখ লাখ শ্রমিকের পরিশ্রমে যে অবিরাম অর্জন ঘটে চলেছে, সেখানে তারা ধ্বংসাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার প্রস্থান স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে তিনি বর্ণবাদের নিগড় থেকে মুক্ত করে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীনতা ও মুক্তির সনদ। আমাদের ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন চলে গেলেন, যখন আমরা ধ্বংসাত্মক অনৈক্য ও অসন্তোষের মুখোমুখি। এ অবস্থার জন্য দায়ী রুগ্ণ ও স্বার্থপরতার রাজনীতি।
তাই আমরা স্মরণ করি সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত, যা কিনা নিঃস্বার্থ ও নৈতিকতাপূর্ণ নেতৃত্বের ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। ১৯৭৫ সালের পরে তিনি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা স্মরণ করে আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আমরা এভাবে নিজেদের প্রতি আস্থা বাড়াতে পারি। নিজেদের দিকে তাকাতে পারি। জনগণের ক্ষমতার ওপর ভরসা করার শক্তি অর্জন করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের লক্ষ্যগুলোর প্রতি আমরা অবিচল আস্থা পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। আমরা মনে রাখব, এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্যই অগণিত শহীদের সঙ্গে আমাদের জাতীয় নেতারা জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ড. কামাল হোসেন: গণফোরামের সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী।