প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, তিস্তা চুক্তি ও আত্মজিজ্ঞাসা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হবে না বলেই নানা সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কার্যত তারাই বেশি খুশি হবে, যারা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে সুনজরে দেখে না। তবে অতি ব্যবহারে এই যুক্তিরও ধার কমতে শুরু করেছে। দিন দিন বরং এই প্রশ্ন সামনে চলে আসছে যে এই যুক্তি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট বিচলিত করে কি না।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটা পাকিস্তানি মাইন্ডসেট অনেক সময় বাধা হিসেবে কাজ করে। তাতে সাতচল্লিশের রেশ আছে। ১৯৭৫ সালের পর তাতে তীব্রতা বেড়েছে। কিন্তু সেটা সব থেকে বড় বাধা কি না, তা নতুন করে ভাবনার দাবি রাখে। ভারত বিভিন্নভাবে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নানামুখী দ্যোতনায় ফিরে আসে। ভারতবিরোধিতার রাজনীতি ক্ষতিকর। ভারতের প্রতি তোষামোদি নীতিও ক্ষতিকর। কোনো সন্দেহ নেই বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির ভারতবিরোধিতার উগ্র নীতি সুবিদিত। তবে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশ রাজনীতি থেকে ভারতবিরোধিতার পাকিস্তানি মাইন্ডসেটের যে উত্তরাধিকার, সেই বলয় থেকে নিজেদের মুক্ত করে আনা। সেটা ভারত পানির হিস্যা দিল কি দিল না, তার নিক্তিতেই বিচার না করা। কিন্তু সেটা যে বাস্তবে কতটা কঠিন, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলেন এ কথা বলে যে, তাঁর প্রতিপক্ষরা ভারতের দালালি করেছেন। এই ‘দালালি’ এমন বিষয় যেখানে দাতা থাকবে, সেখানে গ্রহীতা থাকবে। ভারত গ্রহীতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এটা বলেন যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তখন তার গ্রহণযোগ্যতা যতটা না তৈরি হয় তার থেকে বেশি তৈরি হয় বিভ্রান্তি। যাঁরা বিরোধিতাসর্বস্ব রাজনীতি করেন, তার সঙ্গে আর ফারাক থাকে না। তিনি যে অভিযোগ করেছেন, সেটা নতুন নয়। কিন্তু যেটা নতুন এবং অনেকের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হলো, এই মন্তব্য করার জন্য তিনি এই সময়টা বেছে নিলেন কেন। এমন একটা সময়ে তিনি এই মন্তব্য করলেন, যখন তাঁর ভারত সফর আসন্ন।
ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের বিষয়টি যখন মাঝেমধ্যেই শিরোনাম হচ্ছে, তখন আমাদের জাতীয় গণমাধ্যম সে বিষয়ে একেবারেই নীরব আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি একটি মামুলি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আর সেটার তাল-লয় যথারীতি ভারতবিরোধী। এই গোষ্ঠীর এত দিনকার চেনা সুরের সঙ্গে তার কোনো বৈপরীত্য নেই। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি কেন ক্ষতিকর হবে, তার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই। তবে এটা আমাদের বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না, এটাই তার রাজনীতি। ভোটের রাজনীতি। আবার এটারও প্রমাণ, পাকিস্তানি চিন্তাচেতনার ধারাবাহিকতা বিএনপির একটি অংশের মধ্যে এখনো কম তীব্র নয়।
তাই ঘুরেফিরে প্রশ্ন হলো, সরকারপ্রধানের এই আকস্মিক অবস্থান অর্থাৎ দৃশ্যমান ‘ভারতবিরোধিতা’ কার স্বার্থে? অবশ্য অন্যান্য চুক্তি করে তিস্তা চুক্তি ছাড়াই তাঁকে ফিরতে হলে তখন হয়তো এর ভিন্ন অর্থ মিলতে পারে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (১৭ ফেব্রুয়ারি) একজন বাংলাদেশি কূটনীতিকের বরাতে বলেছে, ভারত এই যাত্রায় সই করাতে ৪১ ধরনের চুক্তি বা সমঝোতার খসড়া বাংলাদেশকে দিয়েছে। এ তথ্য ভারতে প্রকাশ করা অসুবিধাজনক না হলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আরও বিস্তারিত জানাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এতগুলো চুক্তি একবারে সই না হলে পাইপলাইনে থাকবে, ধীরে ধীরে হবে। তবে তিস্তা চুক্তি ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরতে হলে বাংলাদেশকে অধিকতর সংযম রপ্ত করতে হবে। সংযম, সতর্কতা ও ধৈর্য কূটনীতিতে সুফল দেয় বৈকি। কিন্তু যা নিয়ে উদ্বেগ তা হলো, গোড়াতে অন্ধ ভারতবিরোধিতার অবসানে পাকিস্তানি মাইন্ডসেট ভাঙার যে প্রয়োজনের কথা বলেছিলাম, তার বাস্তবায়ন প্রয়াসে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
এদিকে জঙ্গি দমন ও আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নানা সহযোগিতার সম্পর্ক ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, এসবের ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নাকি দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। তার লক্ষণ কী? তাঁদের মতে, তার লক্ষণ হলো চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনা। এই সাবমেরিন যদি আমরা ভিন্ন কোনো দেশের কাছ থেকে কিনতাম বা খোদ ভারতের কাছ থেকে কিনতাম, তাহলে কী হতো? বিশ্বের মাত্র কয়েক ডজন দেশের সাবমেরিন আছে। এই এলিট ক্লাবে সবে আমরা যুক্ত হয়েছি। প্রশ্ন হলো, বাদবাকি দেশগুলো যারা আমাদের মতো কমজোরি, তারা কী করে তাদের দর-কষাকষির সামর্থ্য বৃদ্ধি করে?
আমরা পরিষ্কার যা বুঝি তা হলো, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি লাগবে। এটা আমাদের টিকে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু দলগুলোর কাছে আমরা যেন ভারতপন্থী ও ভারতবিরোধিতাও বর্গা দিয়েছি। এ থেকে একটা নিষ্কৃতি দরকার। অবশ্যই আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর সর্বশেষ মন্তব্যের রেশ ধরে নয়, ভারতকে আমাদের নাগরিক সমাজের তরফে সাফ জানানো দরকার, তিস্তার পানি দিন। আর অপেক্ষা করা যাবে না। গেট খুলতে চুক্তি লাগে না। ভারতের আইনে কোথাও বলা নেই যে পানির ভাগ দিতে চুক্তি লাগবে।
আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতি ধরে রাখতে হবে। আর দর-কষাকষির সামর্থ্য বৃদ্ধি বলতে আমরা যা সহজে বুঝব সেটা হলো, ভারত তিস্তা চুক্তি করতে আগ্রহী নয়, কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা করতে সে বাধ্য হচ্ছে। তিস্তার প্রশ্নে আমাদের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বাধার কথা যেভাবে বলা হচ্ছে, সেটা সমীচীন নয়। আমরা তা সহানুভূতির সঙ্গে অনুভবে নিতে পারি, কিন্তু তা মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। এর সঙ্গে আমাদের বাঁচামরার সম্পর্ক। ভারত তার অন্য বিদেশি মিত্রদের কারও সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়ে কি এভাবে কোনো রাজ্যের অপারগতাকে তুলে ধরেছে? করার কথা নয়। কারণ ভারতের সংবিধান তা তো বলে না।
আমরা মনে রাখি না, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মতো ফেডারেল রাষ্ট্র নয়। তার কোনো অঙ্গরাজ্যের আলাদা সংবিধান ও পতাকা নেই। মার্কিন অঙ্গরাজ্যগুলো কেন্দ্রকে সর্বসম্মতভাবে কিছু ক্ষমতা দিয়েছিল। ওয়াশিংটন ডিসি শুধু সেটুকুরই প্রয়োগ করে থাকে। তাই যা ওয়াশিংটন ডিসি তা কিন্তু দিল্লি নয়। কেন্দ্র বা দিল্লি একটি রাজ্যকে যতটুকু ক্ষমতা ‘অর্পণ’ করেছে, সেটুকুই কেবল তারা প্রয়োগ করতে পারে। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি করা না-করা সর্বতোভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। আমরা যেন এই কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ কিংবা মোদি-মমতা চাপান-উতোর বুঝতে খুব বেশি সময় ব্যয় না করি।
আমাদের, মানে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের একটা আত্মজিজ্ঞাসা দরকার। ওই পাকিস্তানি মাইন্ডসেট যাতে চনমনে না হয়, সে জন্য আমরা মনমোহনের সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার বেদনা চেপে রেখেছি। পরে মোদিজি যখন পাখি ও পানির সীমান্ত না থাকার কথা বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে দরদ দিয়ে বললেন, তখন পুনরায় আশায় বুক বাঁধলাম। তা ফিকেও হলো। তারপরও উষ্মা ততটা প্রকাশ করিনি, পাছে চিহ্নিত শত্রুরা মুখরা হয়। তাঁরা অযথাযথ সুবিধা না পেয়ে যায়। কিন্তু আর তো চলছে না। পিঠ দেয়ালে ঠেকার দশা হয়েছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে ড. গওহর রিজভী তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিকে বলেছিলেন, এ সফর হবে সম্পর্কের রূপান্তরকরণ। আমরা বলব, পানির ন্যায্য হিস্যা ছাড়া এটা আটকে থাকবে।
এবারের সফরে ভারতের আগ্রহে কিংবা ‘পারস্পরিক স্বার্থে’ অনেক নতুন চুক্তি, সমঝোতার আওয়াজ উঠেছে। আর আবারও তিস্তা ছাড়াই আমরা সেসবকেই ‘জাতীয় স্বার্থে’ স্বাগত জানাব, সেটা ভাবতেই বিরাট মর্মপীড়া অনুভব করছি। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার যে সুরে অভিশপ্ত ফারাক্কার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, যেভাবে তিনি ওই বাঁধ ভাঙতে জনমত গড়ে তুলছেন, সে রকমটা কি আমরা পেরেছি? ফারাক্কা প্রশ্নে নিতীশের লংমার্চের চেতনাকে আমরা স্বাগত জানাই। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ৫ জানুয়ারি ২০১৭ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় লেখা এক নিবন্ধে ভারতীয় মূলধারার পত্রিকায় ফারাক্কার অভিশাপ বাংলাদেশে কী পড়েছে, সে বিষয়ে অব্যাহতভাবে নীরবতা পালনের জন্য যথার্থই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘দুঃখের বিষয়, আশির দশকের শেষে ফারাক্কার কারণেই তৃণমূলে ভারতবিরোধিতা বৃদ্ধির প্রথম সূত্রপাত, যার জের আজও চলছে। কিন্তু ভারতের মূলধারার কোনো মুদ্রণ বা অডিও ভিজুয়াল মাধ্যমে গভীরভাবে তা আসেনি।’ ফারাক্কার মরণছোবল নিয়ে আমাদের মূলধারার পত্রিকাগুলোর যা করার দরকার ছিল, সেটা কি আমরা করেছি? আমরা করিনি, যা আরও বেশি শোচনীয়। তবে একটা যুক্তি এই যে, আমরা যাঁরা এটা করিনি, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলাম, ভারতবিরোধিতার চেনা কোরাসে আমাদের বৈধ প্রতিবাদী সুর হারিয়ে যাবে। আমাদের অনেকেই তাই হয়তো এখন ভাবছেন যে এতে লাভ হয়েছে কী? ভারতবিরোধিতার রাজনীতিকে বাড়তে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে ভারত কতটা সংবেদনশীল?
নিতীশের দাবি বিবেচনায় নিয়ে বা না নিয়ে ফারাক্কা ভেঙে দেওয়ার দাবি আমরাও তুলতে পারি। গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়া আমরা গঙ্গা চুক্তি করেছি। এখন আবার নামকাওয়াস্তে শুধু তিস্তা চুক্তি চাই না। আমরা সে জন্য সমুদ্রের মতো নদীতেও আপসে কোনো একটা আন্তর্জাতিক ফয়সালার বিকল্প ভেবে দেখতে পারি। সহজে তিস্তা চুক্তি হবে না। খবর বেরিয়েছে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজর এখন দিল্লির মসনদের দিকে। তিনি জাতীয় রাজনীতির ময়দানে বিচরণ করতে চান। সুতরাং বাংলাদেশকে পানি দেওয়া হতে পারে তাঁর দাবার বড়ে। এই দাবা খেলার রাজনীতিতে আমরা জড়াতে পারি না। কারণ, পানি ছাড়া আমরা বাঁচব না।
শেখ হাসিনার সরকার যদি সত্যিই ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে চায়, তাহলে তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে ভারতকে নিন্দামন্দ করে তা ফলপ্রসূ হবে না। দিল্লিতে গিয়ে পরিষ্কার করে তাঁকে বলতে হবে, তিনি এখনই তিস্তা চুক্তি চান। বাকি অভিন্ন নদ-নদীর বিষয়ে গ্যারান্টি ক্লজযুক্ত একটি আমব্রেলা চুক্তি চান। সে জন্য তিনি একটা সুনির্দিষ্ট সময়সীমার ঘোষণা চান।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই ও পাকিস্তানপন্থীদের বৈধভাবে দমন এবং সর্বোপরি সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের দাবিতে ভারতের উচিত তাঁর হাত শক্তিশালী করা। তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসহানি ঘটালে তাতে পাকিস্তানি দিলই স্বস্তি পাবে। গ্যাস থাকলে আমরা ভারতকে গ্যাস দেব ও দিতাম। যা ছিল না, তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে সাহসী হতে পারে? তারা এবারে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের চুক্তি করবে, ভালো কথা, আমরা দেব। তবে ভারতের পক্ষে পানি না দেওয়া আর বাংলাদেশের পক্ষে গ্যাস বা অন্য কিছু না দেওয়া বা দিতে না পারাকে কখনো এক পাল্লায় মাপা যাবে না। পানি বাংলাদেশের মৌলিক মানবাধিকার।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]