প্লিজ, এ নির্বাচন করবেন না

তুলি
তুলি

গত শুক্রবার এই আবেদনটি জানিয়েছিলাম। আজ আবারও তা পেশ করছি। এটা আমরা করছি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, সংবিধানের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি ভোটারদের আস্থা ধরে রাখায় আমাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে অর্থনীতির ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তা এড়ানোর লক্ষ্য থেকেও আমরা এটা করছি।
ক. নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীন দলের উচিত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত হওয়া। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনগত ভিত্তিগুলো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
খ. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদের অধিবেশন পুনরায় ডাকার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানাতে পারেন এবং রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন।
গ. উল্লিখিত উদ্দেশ্যে যদি নবম জাতীয় সংসদের অধিবেশন আবার ডাকা হয়, তাহলে বিরোধী দলের উচিত হবে, কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই তাতে যোগ দেওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করা এবং হরতাল, অবরোধসহ এ ধরনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করা।
ঘ. জামায়াতের অংশগ্রহণ অবশ্যই হতে হবে হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর কেন বিবেচনায় নেওয়া উচিত?
এক. যেহেতু ভোট গ্রহণ ছাড়াই ১৫৩টি আসনের সাংসদেরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন এবং অবশিষ্ট ১৪৭টি আসনের ফলাফলও প্রধানত জানা, সেহেতু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ এবং যে সরকার গঠন করা হবে, তার প্রতি দৃশ্যমান কোনো জনসমর্থন থাকবে না। সেই সরকারের ‘জনগণের ম্যান্ডেট’ থাকবে না, কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনার জন্য প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারের যা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।
দুই. সংবিধানে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এমন নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, যাতে পূর্ণবয়স্ক নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে ‘জনগণের ইচ্ছা’র প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু এই নির্বাচনে সেটা একেবারেই ঘটবে না।
তিন. সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে এবং আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি এড়াতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে—এই দুটি যুক্তির কোনোটাই এখানে খাটে না, উভয় যুক্তিই মন্দ ধারণাপ্রসূত এবং এমনকি দুষ্টচিন্তাপূর্ণও হতে পারে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যেই ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত করা খুবই সম্ভব। যদি কোনো আইনগত ফাঁকফোকর থেকেও থাকে, সেটা বন্ধ করা যাবে নবম জাতীয় সংসদের পুনঃ আহূত অধিবেশনে।
চার. ভোটারবিহীন নির্বাচন হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তার ফলে গণতন্ত্রের প্রতিও জনগণের আস্থা হ্রাস পাবে।
পাঁচ. এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কার্যত একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে পুরোনো সংশয়-সন্দেহ ফিরে আসবে। সন্দেহের ভিত্তি হবে বেশ শক্ত, তাতে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে দলটির ভাবমূর্তি ও আবেদন ক্ষুণ্ন হবে এবং ভবিষ্যতে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ যেকোনো নির্বাচনে তার জয়লাভের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
ছয়. ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজের জন্য যে ভবিষ্যৎ কল্পনা করছে, তা টেকসই হবে না এবং সে কারণেই তা অধরা, মরীচিকার মতো। আমরা আবারও বলছি, যেসব ভোটার ভোট দিতে পারবেন না, বা ভোট দিতে যাবেন না, নির্বাচনের পর তাঁরা শাসক দলের বিরুদ্ধে একটা ‘আক্রোশ’ বোধ করবেন। তাঁরা বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারেন, সক্রিয় সমর্থন ব্যক্ত করতে পারেন বিরোধী দলের স্বার্থ বা খোদ দলটির সমর্থক না হয়েও। একটা বঞ্চনাবোধ কাজ করতে পারে তাঁদের মনে, অথবা তাঁদের মনে হতে পারে, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে তাঁরা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারেন, যা দলটির জন্য ভবিষ্যতে বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সাত. জনগণের ওপর একটা ভোটারবিহীন নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলেই আওয়ামী লীগ বেশি উপকৃত হবে। সে যে নির্বাচনে জয়ী হতে পারে, এই আস্থা আওয়ামী লীগের ফিরে পাওয়া প্রয়োজন।
আট. আওয়ামী লীগ আমাদের জনগণের একটা মৌলিক মানসিকতার কথা ভুলে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এ দেশের জনগণ বরাবরই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, তারা বরং ‘লাঞ্ছিত-নিপীড়িতের’ প্রতি খানিকটা সহানুভূতিশীল। সরকার বিরোধী দলের ওপর যাবতীয় রকমের দমন-পীড়ন চালানোর মধ্য দিয়ে তাদের ‘লাঞ্ছিত-নিপীড়িতের’ ভাবমূর্তিই বাড়িয়ে তুলছে। বিপুলসংখ্যক পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব মোতায়েন, বিরোধীদলীয় নেতাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে জনসাধারণকে ব্যাপক হয়রানি, শাসক দলের কর্মীদের প্রতি পুলিশ ও র‌্যাবের প্রকাশ্য সমর্থন ইত্যাদির ফলে ‘লাঞ্ছিত-নিপীড়িত’দের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়ছে।
নয়. ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির হার অত্যন্ত কম হওয়ার আশঙ্কা খুবই প্রবল। নামীদামি নেতাদের কেউ কেউ এবং তাঁদের কর্মীরা হয়তো ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখানোর লক্ষ্যে নিজেদের ভোটে ব্যালট বাক্স ভরানোর লোভ সামলাতে পারবেন না; কিছু নির্বাচনী কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে জাল ভোটের মাধ্যমেও সেটা করা হতে পারে। এ রকম ঘটলে বিএনপি সরকারের আমলে মাগুরা নির্বাচনের মতো কেলেঙ্কারির লজ্জা-কালিমা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের গায়েও লাগবে। আওয়ামী লীগের একান্ত উচিত, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে এ রকম কেলেঙ্কারি এড়ানোর চেষ্টা করা।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন নিয়ে যে ছকই কষে থাকুন না কেন, তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রথমত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে—এমন আস্থা জনমনে সৃষ্টি করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বরং উল্টো ধারণাই মানুষের মনে তৈরি হয়েছে। ভোট গ্রহণের আগেই ৫২ শতাংশ ভোটারকে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নয় কোটি ২০ লাখ ভোটারের মধ্যে পাঁচ কোটিরও বেশি ভোটার এই নির্বাচন গ্রহণ করবে না। কারণ, এতে তাঁরা অংশ নেননি। ফলে ‘জনগণের ইচ্ছা’র প্রতিফলনের একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া হিসেবে এই নির্বাচনের মর্যাদা ইতিমধ্যেই ধসে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, মাত্রাতিরিক্ত পুলিশি দমন-পীড়ন, বিরোধী দলের নেতাদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার, পরোয়ানা জারি ও মামলা দেওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। বিএনপির প্রধান নেত্রীকে তাঁর গৃহে অবরুদ্ধ করে রেখেও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার অভাব কমানো যায়নি। তৃতীয়ত, এরশাদকে সিএমএইচে আটকে রাখা এবং রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টি ভাঙার চেষ্টার ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আরও ধ্বংস হয়েছে।
আমরা খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছি, বল সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কোর্টে। আমরা সুচিন্তিতভাবে মনে করি, রাজনৈতিক আপস-সমঝোতা ছাড়া সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে না। কোনো সমঝোতা না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তার ইঙ্গিত রয়েছে নতুন বছরের প্রথম দিনেই বিরোধী দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ঘোষণার মধ্যে। সরকার যত যা-ই করুক না কেন, আরও পুলিশ, আরও র‌্যাব নামিয়ে ‘শান্তি’ ফিরিয়ে আনার যত চেষ্টাই করুক, কোনো ফল হবে না। জনজীবন কেবল তখনই স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে, যখন জনগণ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে নিরাপদ বোধ করবে। এটা সবার আগে বোঝা উচিত আওয়ামী লীগের, কারণ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারাও ‘লাঞ্ছিত-নিপীড়িত’ হিসেবে একই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল।
আমাদের নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও সাহসিকতা দেখানোর এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্ত।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, সামান্য সংক্ষেপিত

মাহ্ফুজ আনাম: সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার।