ভালা করি ঘর বানায়া কয় দিন?

আচ্ছা, আপনাদেরও কি এই রকম হয়? ধরুন, একটা কাজ করতে হবে। ধরা যাক, আপনি কাউকে একট চিঠি লিখবেন, বা কোনো একটা বিল জমা দেবেন, কোনো একটা কিছুর জন্য আবেদন করবেন। কাজটা করার জন্য আরও তিন মাস সময় হাতে আছে। আপনি প্রথমে ভাবলেন ঠিক আছে, দুই মাস সময় হাতে রেখেই কাজটা করে ফেলব। এক মাস যায়, দুই মাস যায়, তারপর যখন তিন মাস যায় যায়, তখন আপনার হুঁশ হয়, এবং একেবারে শেষের দিন গিয়ে কাজটা সারেন?
যদি আপনার এই রকম হয়ে থাকে, তাহলে বুঝবেন, আপনি আমারই দলে। এবং আমার ধারণা, বেশির ভাগ মানুষই আসলে কাজ ফেলে রাখে, এবং শেষ মুহূর্তের আগে কাজ শেষ করে না। আপনারা যাঁরা আমার মতোই শেষ দিনের আগে কাজ শেষ করেন না, তাঁদের জন্য নিউ ইয়ার রেজুলেশন, নতুন বছরের অঙ্গীকার:
নতুন বছরে আমি হব ভালো ছেলে
সময়ে সারব কাজ রাখব না ফেলে।
আপনার মূল্যবান সময় কি ফেসবুকে অপব্যয়িত হচ্ছে? তাহলে আসুন, নতুন বছরে এই প্রতিজ্ঞা করি:
নতুন বছরে আমি এই পণ করি
ফেসবুক না পড়ে যেন সত্যি বই পড়ি।
আমার ওজন বেড়ে যাচ্ছে। ভুঁড়ি সামলাতে পারছি না। জিমনেসিয়ামে যাবার জন্য বার্ষিক কার্ড করেছিলাম, টাকা ব্যয় হয়েছে, ক্যালরি খরচ হয় নাই। একটা মেশিন কিনেছি, ব্যায়ামের যন্ত্র, সেটা ঘরের একটা কোণে অযত্নে পড়ে আছে, প্রথম দুই-তিন দিনই যা শরীরচর্চা হয়েছে, তারপর বেমালুম ভুলে গেছি সেই যন্ত্রের কথা। আপনাদেরও কি এই রকম হয়?
তাহলে আসুন, প্রতিজ্ঞা করি:
নতুন বছরে আমি এই করি পণ
খাওয়া কম ব্যায়াম বেশি কমাব ওজন।
ইনশা আল্লাহ, আগামী নতুন বছর পর্যন্ত যদি বেঁচে থাকি, আগামী বছরেও এই প্রতিজ্ঞাগুলোই নতুনভাবে উচ্চারণ করতে পারব। মানুষ প্রতিজ্ঞা করে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার জন্যই।
এই জন্যই তো লোকে বলে, সিগারেট ছাড়া খুব সোজা। আমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বহুবার সিগারেট ছেড়েছি।
আমি অবশ্য ধূমপান করি না। এই প্রতিজ্ঞা তাই আমাকে করতে হয় না, এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবারও দরকার পড়ে না।
***

এই পর্যন্ত পড়ার পর অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। একতরফা একটা নির্বাচন সামনে। বিরোধী জোট সেই নির্বাচন বর্জন করেছে। অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। দেশে চলছে লাগাতার অবরোধ, লাগাতার হরতাল, লাগাতার বোমাবাজি, লাগাতার অগ্নিসংযোগ। দ্যাশ শ্যাষ। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, কৃষকদের কপাল পুড়ে ছাই, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি ৫-এর নিচে নেমে যেতে বাধ্য। নেতাদের আছে শুধু ক্ষমতাপ্রীতি। কেউ দেশের কথা ভাবছে না। এই অবস্থায় আপনি রসিকতা করেন। এই অবস্থায় তুমি মিয়া ক্যালরি, কোলেস্টেরল, ফেসবুক নিয়া ঘ্যানর ঘ্যানর করো।
তিন বছর ধরে একই কথা বলছি। বলছি যে, একতরফা নির্বাচন চাই না, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। বলছি, ভোটে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন চাই। কেউ আমার কথা শুনেছে?
গতকাল একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বললেন, বাংলাদেশে আছে আসল গণতন্ত্র। বকাওয়ালা বকে যাচ্ছে, লেখাওয়ালা লিখে যাচ্ছে, শোনাওয়ালা শুনে যাচ্ছে, করাওয়ালা নিজের মতো করে যাচ্ছে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
প্রথম আলো লিখেছে, হাল ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। আশ্চর্য একটা দল। জরিপ বলছে, তারা জনপ্রিয়। জরিপ বলছে, তাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেশির ভাগ মানুষই চায়। তার পরেও তাদের আন্দোলনে লোক হয় না। দেড় কোটি মানুষের শহরে দেড় লাখ না হোক, ১৫ হাজার লোক পথে নামবে না? নামবে কেন, কোনো নেতা নেমেছেন? নামবেন কী করে, সব নেতা তো কারাগারে। কথা কি সত্য? টিভি টক শোতে তো এখনো বিএনপির নেতাদের দেখি। কারণ হলো, বিএনপি সর্বহারাদের দল নয়। তাঁদের শরীরে মেদ আছে। নড়তে-চড়তে কষ্ট হয়।
শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা কোনো গণতন্ত্রের জন্য বড় দুঃসংবাদ। আমরা এখন সেই দুঃসংবাদের মধ্যে আছি।
***

নতুন বছরে তাই আমরা কতগুলো রেজুলেশন নিতে পারি।
১. আগামী এক বছরে বাংলাদেশের সব জমি কিনে ফেলব।
২. আগামী এক বছরে বাংলাদেশের সব নদী ভরাট করে ফেলব।
৩. আগামী এক বছরে বাংলাদেশের সব গাছ কেটে ফেলব।
৪. আগামী এক বছরে প্রত্যেক সরকারি নেতার জন্য দুইটা করে টেলিভিশন চ্যানেল, পাঁচটা করে ব্যাংক, ছয়টা করে বিমা বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
রসিকতা করছি। বুঝতেই পারছেন।
এবার একটা সিরিয়াস কথা। গত বছরের সবচেয়ে স্মরণীয় উক্তি হলো: ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।’
***

না না, রাজনৈতিক আলোচনা বাদ। এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। যে প্যাঁচ আপনি-আমি লাগাই নাই, যে সুতার কোনো অংশ, না ডগা, না মাঝখানেরটা, আপনার আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নাই, সেই প্যাঁচ আমরা খুলব কীভাবে। যারা প্যাঁচ লাগিয়েছেন, কেবল তাঁরাই খুলতে পারবেন।
বরং আসুন, আমরা গান-বাজনা করি। হাসন রাজার গানটা গাই।
লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার।
কী ঘর বানামু আমি শূন্যেরও মাঝার।
ভালা করি ঘর বানায়া কয় দিন রমু আর,
আয়না দিয়া চায়া দেখি পাকনা চুল আমার।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।