হাসিনা-খালেদা কেউ কথা রাখেননি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘তেত্রিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সময়টি আরেকটু বেশি। ৪৩ বছর। এই ৪৩ বছরে সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের কেউ কথা রাখেননি। সামরিক স্বৈরশাসকেরা কখনোই গণতন্ত্রী হতে পারেন না। কিন্তু গণতন্ত্রীরা যখন সেই স্বৈরশাসকের পথে পা বাড়ান, তখন আর ভরসা রাখার জায়গা থাকে না।
সামরিক স্বৈরশাসক ও গণতন্ত্রীদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য কী? সামরিক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় থেকে প্রশাসন ও নানা রকম বাহিনী কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণি পার হন এবং নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এত দিন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তফাত ছিল প্রথমটি জনগণের মধ্য দিয়ে উঠে এসে জনগণের কাতারে নিজেকে রাখতে সচেষ্ট থেকেছে। দ্বিতীয় পঙিক্তভুক্ত দল দুটি তৈরি হয়েছে ক্ষমতায় থেকে, তারা গণভোট ও নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছে। শেখ হাসিনা বরাবর তাদের নির্বাচনী প্রহসন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের অপবাদ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই অপবাদটি তাঁরই গায়ে এভাবে লাগবে, কেউ ভাবতে পারেননি। সব সম্ভবের দেশে কিছুই অসম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, দেশে এখন একটি যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে চেতনাবিরোধীদের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার সঙ্গে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের তথা গণতন্ত্রের তো বিরোধ থাকতে পারে না। শুরু থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত হলে, সব মানুষকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শামিল করতে পারলে অগণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি কখনোই সমাজে শিকড় গাড়তে পারত না।
এত দিন মানুষ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ফারাক খুঁজত, কিছুটা নীতির, কিছুটা জন্মপরিচয়ের। একটি প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেই ফারাকটুকু ঘুিচয়ে দিলেন। এখন মানুষ বলবে, সব শিয়ালের এক রা। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি যদি বিএনপির কলঙ্কতিলক হয়ে থাকে, তাহলে ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকেও বিজয়টিকা দেবে না।
শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া কেউ কথা রাখেননি। তাঁরা বলেছিলেন সুশাসন দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, মানুষের ভোটের অধিকার দেবেন। দেশবাসীকে শান্তি ও স্বস্তি দেবেন। কিন্তু এখন দেখছি রাস্তায় বের হলেই আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। বছর খানেক আগে শেখ হাসিনা বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, নির্বাচন হবে, নির্বাচন হবে, নির্বাচন হবে এবং বিএনপিও সেই নির্বাচনে আসবে। তিনি নিয়মরক্ষার নির্বাচন করলেন কিন্তু বিএনপি দূরে থাক, সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদকেও নির্বাচনে আনতে পারেননি (যদিও তাঁর দলের একাংশ নির্বচন করছে)।
খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি যে আন্দোলন করছেন, তা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তিনি আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পারেননি। বিরোধী দল কর্মসূচি দিলেই বাসে-ট্রাকে আগুন জ্বলে। সরকারি সম্পদ ধ্বংস হয়। সর্বোপরি বিএনপির চেয়ারপারসন যে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করছেন, তাতে সেই জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেননি। কেবল দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে গণ-আন্দোলন হয় না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের নেতারা যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এই যুদ্ধে জিততেই হবে। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই যুদ্ধের নিয়মগুলো মানছেন না। তাঁরা যুদ্ধের কথা বলছেন, কিন্তু কেন এবং কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সেটি জনগণকে বোঝাতে পারেননি।
১৯৭১ সালে এই বাংলাদেশে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তির জন্য যুদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ জনগণ তাঁর কথায় সাড়া দিয়েছিল এবং দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করেছিল।
কিন্তু ৪৩ বছর পর আজ নেতা-নেত্রীরা যে যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছেন, সেই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ সাড়া দিচ্ছে না। মানুষ তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে বিরোধী দল যে সহিংসতা চালাচ্ছে, মানুষ যেমন তার সঙ্গে নেই; তেমনি সংবিধান রক্ষার নামে সরকার যে নির্বাচনী মহড়া দিয়ে চলেছে, সেটিও তারা সমর্থন করতে পারছে না।
ইতিমধ্যে ১৫৩ জন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। ৫৩ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। বাংলাদেশে এ রকম নির্বাচন আর কখনো আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে কি না সন্দেহ। এতদিন সূক্ষ্ম ও স্থূল কারচুপি, ভোট ডাকাতি, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মহড়া দেখেছি। ৫ জানুয়ারি প্রার্থীবিহীন নির্বাচনের নতুন রেকর্ড তৈরি হতে যাচ্ছে। যে নির্বাচনের ফল ভোটের আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়, সেটি নির্বাচন নয়। অন্যদিকে বিরোধী দল ‘গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব’ রক্ষার নামে বাসে-ট্রাকে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারারও রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে। সবই চলছে গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার নামে। দেশ ও মানুষের কথা কেউ ভাবছে না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, একই পরিস্থিতি আমরা লক্ষ করেছি ২০০৬-০৭ সালে। সেই সময় বিরোধী দলের প্রবল আন্দোলন, নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের বিরোধিতাও তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে সামনে রেখে বিএনপি ২২ জানুয়ারির নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু এক-এগারোর পরিবর্তন সবকিছু ভন্ডুল করে দেয়। এবার এক-এগারোর আশঙ্কা নেই বলে শেখ হাসিনা হয়তো পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু তাতে গণতন্ত্র রক্ষা হবে না, দেশে শান্তি আসবে না। এখন আওয়ামী লীগের সমর্থক পেশাজীবীরা যেভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, সে সময় বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক পেশাজীবীরাও ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইতেন। সব সমাজে সব সময়ই একশ্রেণীর অন্ধ স্তাবক থাকেন। তাঁদের সংখ্যা ভারী হলে দেশের বিপদ। বাংলাদেশ এখন ভীষণ বিপদে আছে।
প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনী অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভোটাররা দল ও প্রার্থীদের অঙ্গীকারনামা দেখে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেন, কাকে ভোট দেবেন, কাকে দেবেন না। এবার নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে, প্রার্থীদের অঙ্গীকার নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সবাই উদ্বেগে আছে ৫ জানুয়ারি কী হবে? তার পর? আরও কত লাশ পড়বে? আর কতটি বাস-ট্রাক-গাড়ি পুড়বে? আর কত দিন বিরোধী দলের নেতার বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক বা জলকামান থাকবে?
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দিনবদলের অঙ্গীকার করেছিল। তারা জনগণের দিন কতটা বদল করেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেক মন্ত্রী-এমপির দিন যে সত্যি সত্যি বদল হয়েছে সন্দেহ নেই। কারও সম্পদ বেড়েছে শত গুণ, কারও হাজার গুণ। মন্ত্রী-এমপি হওয়া এখন মস্ত বড় বিনিয়োগ। প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, তাঁর মন্ত্রীরা চৌকস না হলেও সৎ। সততার এই নমুনা!
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচনী ভাষণে কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতেই এ নির্বাচন। সাংবিধানিকভাবেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ তাঁর বর্ণিত সেই গণতন্ত্র কি মানুষকে বাদ দিয়ে? যে নির্বাচনে মানুষের অংশগ্রহণ নেই, সেটি কীভাবে নির্বাচন হয়?
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি আনতে পারেননি। এটা যত না বিরোধী দলের ব্যর্থতা, তার চেয়ে বেশি ব্যর্থতা সরকারের। ২০০৮ সালে বিএনপিও প্রথমে নির্বাচনে আসতে চায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনে আনতে পেরেছিল। কিন্তু এবার শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলোচনা করতে চেয়েছেন এমন প্রমাণ নেই। সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকার সেই কাজটি করতে পারেনি—এটাই সত্য।
১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়াও বিরোধী দল আসেনি—এ অজুহাত দেখিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আরেকটি নির্বাচন করেছিলেন। বিএনপির নেতারা এখন বলছেন, সেই নির্বাচন ছিল শুধু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বিল পাসের পরপরই সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বাধ্যবাধকতার নির্বাচনটির মেয়াদ কত দিন হবে, তা নির্ভর করবে গায়ের জোরের ওপর। যত দিন সরকার জোর দেখাতে পারবে, তত দিন তারা ক্ষমতায় থাকবে। আর যত দিন বিরোধী দল সেই জোরের ওপর দ্বিগুণ জোর দেখাতে না পারবে, তত দিন একাদশ সংসদের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ যে একটি স্থায়ী যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে, যাতে কেউ জিতবে না।

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
[email protected]