নিয়োগ পর্বে আউটসোর্সিং অদক্ষতারই প্রকাশ

.
.

এখন প্রশ্ন থাকছে যাদের কাছে আউটসোর্স করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে কোনো বিতর্ক নেই। তবে এগুলো করার জন্য তো এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। এসব পরীক্ষার ফি থেকে শিক্ষক-কর্মচারীরা কিছুটা ভাতা পান, এটা বড় বিষয় নয়। তাঁদের ম্যান্ডেটবহির্ভূত ক্রমবর্ধমান কাজ একপর্যায়ে দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা অসংগত নয়। ছাত্রদের পাঠদান, নিরন্তর জ্ঞান আহরণ ও গবেষণা যাঁদের কাজ, তাঁরা কেন ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় এ হারে শক্তি ক্ষয় করবেন, এটা বোধগম্য নয়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা এগুলো চেয়েও আনছেন না। প্রতিষ্ঠানগুলোই সামর্থ্যের অভাব কিংবা দায়িত্ব এড়াতে পরিস্থিতিকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করলে প্রকৃত যে তথ্য বেরিয়ে আসে তা হলো, তারা নানামুখী তদবিরের চাপ সহ্য করতে পারে না। পারে না নিজেদের কিছু সহকর্মীকে নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে বিরত রাখতে। তাই ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কাছে দায়িত্ব চাপিয়ে তারা অনেকেই নিজেদের নির্ভার মনে করছে। আর সেই কমিটিরও যথোচিত সামর্থ্য নেই, এটা সুপ্রমাণিত। এ জন্য বিশাল লোকবলসহ অনেক অবকাঠামো প্রয়োজন। তাই আউটসোর্সিং! কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা তো সেই কমিটি কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন বোর্ডই নিয়ে থাকে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাও থাকেন। তখনো তো তদবির চলে। নিয়োগ-বাণিজ্যের আশঙ্কাও উপেক্ষা করা চলে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এই ভার বহনে অক্ষমতা লোকবল ঘাটতি বা অন্য কিছুর নয়। ঘাটতি শুধু নৈতিক মনোবলের।

এটা যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ক্রমান্বয়ে আরও তলানিতে যাবে। যাঁরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করছেন বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যে, তাঁদের নিজেদের লোকবল নিয়োগ দেওয়ার অক্ষমতা নজরে আসার মতো।অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এত দিন কিন্তু মোটামুটি একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ছিল। কিন্তু রিজার্ভ কেলেঙ্কারি এবং কিছু ব্যাংকের গুরুতর অনিয়ম সময়মতো চিহ্নিতকরণে ‘ব্যর্থতা’য় এতে চিড় ধরেছে। এ ক্ষেত্রে বরং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেওয়া সংগত। এটা কি আদৌ অসম্ভব?

অবশ্য চলমান প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে কতটা সম্ভব তা দেখার বিষয়। ডিসি অফিসের কেরানি, পিয়ন কিংবা জেলায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগেও রাজনৈতিক তদবির বড় ধরনের প্রভাব রাখছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নিয়োগ-বাণিজ্য। আর এগুলো এখন রাখঢাকের কোনো বিষয় নয়। এ ধরনের নিয়োগে তদবির সহজ করতে বিধি সংশোধন করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রাপ্তির ভিত্তি তদবির কিংবা টাকা। আর যাঁরা তদবির করেন, তাঁরাও অনেকে টাকা নিয়েই করেন—এরূপ অভিযোগও রয়েছে। সম্মানজনক ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে বিরাজমান অবস্থায় তারা বিপন্ন প্রজাতি। যুগ যুগ ধরে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষই নিয়োগবিধি অনুসারে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দিয়ে আসছে। এ অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় সহজেই অনুধাবন করা যায়। কর্মকর্তাসংকটে ভুগছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার চাকরির জন্য এদিক-সেদিক ছুটছে। আর আলোচনার শুরুতে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে কথা হলো, সেটি একটি কোম্পানি। কোম্পানি আইনেই ব্যাংকটির চলার কথা। সরকার শতভাগ শেয়ারের মালিক। পরিচালনা বোর্ডেও তাদের প্রতিনিধিত্ব শতভাগই। সর্বক্ষেত্রে এজাতীয় নিয়োগের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী থাকা কিংবা অন্যের ওপর চাপিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হওয়া উভয়টিই অগ্রহণযোগ্য।

ব্যাপক অর্থে আউটসোর্সিং কথাটির নানাবিধ প্রয়োগ আছে আমাদের সরকারব্যবস্থায়। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো কোনো কাজ নিজেরা না করে অন্য কারও ওপর তা অর্পণ করে। আর সেটা সময় ও খরচ বাঁচানো এবং মান উন্নয়নের জন্য। প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগেও এমনটা হতে পারে না, তা নয়। তবে এমন করতে হলে আইনের আওতায় নিয়েই করা যথোচিত হবে। এখন যা করা হচ্ছে, তা অনেকটা উৎকট তদবির ও নিয়োগ-বাণিজ্যের চাপ কিছুটা কমাতে। কিন্তু তা করতে গিয়ে মূল প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্যই যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এসব ব্যাংক কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান অতীতে বহু গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ নিজেরাই দিয়েছে। সেসব নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি চাকরি করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। সুতরাং সামর্থ্যের অভাবে নয়, একটি ভয় ও শঙ্কা এই অবস্থা সৃষ্টি করছে। আর তা ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে। এ রকম হতে থাকলে এখন যাদের দায়িত্ব দিয়ে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে, তাদের সম্পর্কেও অভিযোগ আসতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত। যে যাঁর কাজ নিয়ে থাকুন। অন্যের ঘাড়ে ফেলবেন না। প্রশাসনের দৈন্যদশা সর্বজনবিদিত। আর শুধু রাজনৈতিক অঙ্গীকারই এটা কাটানোর জন্য বহুলাংশে কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক অবক্ষয় নড়বড়ে করে ফেলেছে প্রশাসনকে। প্রয়োজন একে বিপরীতমুখী করা। আর তা না করে ভালোগুলোকেও বিতর্কিত করার ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া অসংগত।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব