দুই বেয়াইয়ের অবাক কাণ্ড

.
.

দুই বেয়াইয়ের কাহানি শোনাব।
তবে তার আগে বলি সার্বিক নির্বাচনী আঁচ গতকাল কীভাবে গায়ে লাগল। লাল সিরামিকের ভবনটিতে তখন সন্ধ্যা। আধা ভুতুড়ে, আধা নিস্তরঙ্গ পরিবেশ। তবে হ্যাঁ, প্রার্থী ও ভোটারের আকাল পড়লেও মিডিয়া কর্মীদের ভোট কাভারের প্রস্তুতি ছিল অভূতপূর্ব। বেসরকারি ফলাফল টানানোর কাঠ বোর্ডে শিট লাগল সাড়ে ছয়টায়। দেখি প্রথমেই জেনারেল এরশাদের নাম। সংসদীয় গণতন্ত্র, তাই তাঁকে বলতে পারি ছায়া প্রধানমন্ত্রী। ফলাফলের ফিতা কাটার জন্য একদম উপযুক্ত ব্যক্তি। দেখি রংপুর-৩ আসনের ১০ কেন্দ্রের ফল। এক হাজার ৭৯৯ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রাণঘাতী প্রাণহীন নির্বাচনে ভোটার অনুপস্থিতির ভয়ানক দুরবস্থার কারণ খুঁজলাম। ১. প্রতিদ্বন্দ্বিহীনতাই মূল। সহিংসতাও এতটা হতো না। ১৯৯৬-এর চেয়েও খারাপ হতো না। যদি একতরফা ভোট ৩০০ আসনেই হতো। ২. বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে ধরনা দেওয়া হয়নি। তাদের ভোটকেন্দ্রে আনতে টাকাপয়সাও কম খরচ হয়েছে। ৩. আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভোটার স্লিপ পর্যন্ত দেননি। ভোটাররা এ জন্য দারুণ বিপাকে পড়েছেন। ৪. ১৫৩টি আসনে নির্বাচন না হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ৫. স্থানীয় দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। যেখানেই দাবিদাওয়া কম পূরণ হয়েছে সেখানে ভোটাররা তুলনামূলক কম গেছেন।
একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা আমাকে বলেন, জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা সরকারবিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে, বিচার বিভাগ পৃথক্করণের কারণে। এ ছাড়া অতীতের তুলনায় বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতাও বেড়েছে। বিএনপি এর সুবিধা পেত।
কমিশন সচিবালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে। এর আগে কখনো রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেননি। লোকবলের ঘাটতি ছিল। এবার তা ছিল না। তাই কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ১৪৭ আসনের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কমিশনের ক্যাডার কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পাবেন। ক্ষমতাসীনেরা কথায় কথায় যে ছয় হাজার নির্বাচনের কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন, তা তাঁদেরই অর্জন। অথচ তাঁদের বিশ্বাস করা হলো না। ডিসিরাই নির্ভরযোগ্য থাকলেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুজন বিভাগীয় কমিশনারসহ ৫৯ জন ডিসি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। সচিবালয় থেকে বলা হয়েছিল, ডিসিরা সরকারের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ। তাই নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে দায়িত্ব পালন করালে বেশি সুফল মিলবে। কিন্তু সেটা মেনে নেওয়া হয়নি। এমনকি ১৪৭ আসনের ২৮৭ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রায় আড়াই শ ছিলেন ইউএনও। বাকিরা ইসি কর্মকর্তা।
শুনলাম দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৪৯টি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের তথ্য নিলেন। ওই নির্বাচনের বিস্তারিত তথ্য কমিশন সচিবালয়ে নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তখন ৪৯ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। সহিংসতা ও অন্যান্য কারণে ৩০০ থেকে ৪০০ ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল। ইতিহাসে এবারই প্রথম ইসি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে নির্বাচন সামগ্রী কেন্দ্রগুলোতে পাঠিয়েছে। ’৯৬-তেও যথারীতি নির্বাচন কর্মকর্তারা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিয়েছেন। বিকেল চারটার পরে প্রশ্নের জবাবে একজন কমিশনার জানালেন, সেনারা দিনভর ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হয়েই থেকেছেন। তাঁদের ডাকতে হয়নি।
গতকালের নির্বাচনে ১৪০টি নির্বাচন তদন্ত কমিটি সক্রিয় ছিল। যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের বিচারক ও একজন সহকারী জজের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ম্যান্ডেট ৩ থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে তেমন কারও বিরুদ্ধে তাঁদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়নি। তার মানে ইসি ও ‘আইনের’ দৃষ্টিতে তেমন কোনো নির্বাচনী অপরাধ ঘটেনি। অথচ সংক্ষিপ্ত বিচার করে অনধিক ১০ বছরের জেল দেওয়ার ক্ষমতা ওই কমিটির ছিল। তার মানে দাঁড়াল এই রাষ্ট্রে শুধু ইসি অসহায় তা-ই নয়; বিচার বিভাগও অসহায়। নইলে গত কয়েক দিনে যত নাশকতা ঘটল, ব্যালট ছিনতাই ঘটল, তা শত শত আদালত সদা সক্রিয় ও সতর্ক থাকলেও কেন কাউকে শাস্তি দেওয়া গেল না? সেনা না থাকলে সহিংসতা আরও তীব্র হতো।
এবার দুই বেয়াইয়ের প্রসঙ্গ। যশোর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিন। তাঁর বেয়াই উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে যশোর-২ আসনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়েছেন। নাম অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম। আফিল উদ্দিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাই তিনি প্রকাশ্যে যশোর-২ আসনের তাঁর বেয়াইয়ের পক্ষে প্রচারণায় নামেন। ‘প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের ১০০ জন কর্মী ভোটকেন্দ্র দখল করে বেলা ১১-৫৯ মিনিটের মধ্যে নৌকা প্রতীকের জয় সুনিশ্চিতকরণ’-এর ফর্মুলা দেন। এটা ওই অঞ্চলে আলোড়ন তোলে। বাজারে তাঁর বক্তৃতার সিডি বিক্রি হয়। ২ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘আ.লীগ সাংসদের নির্দেশ ১০০ কর্মী কেন্দ্রে থাকবে, পালাক্রমে ভোট দেবে’ মর্মে খবর ছাপা হয়। কর্মীদের সাহস দিয়ে আফিল উদ্দিন বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি কোনো প্রশাসনিক সমস্যায় পড়েন আমাকে বলবেন, আমি জবাব দেব। তার (বেয়াই) জন্য যা যা করণীয় ভোটের মধ্যে তা কিন্তু করা লাগবে। কী করা লাগবে, আমি তা মাইকে বলতে পারব না। একা একা জিজ্ঞেস করবেন, বলে দিব।’
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখানে কলকে না পাওয়ার কথা। যাঁর বিরুদ্ধে এই প্রস্তুতি, তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। নিজেকে বিদ্রোহী নয়, শেখ হাসিনার স্নেহধন্য দাবি করেন। তাঁকে নাকচ করা যাবে না। সপ্তম সংসদে তিনি জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে সরকারদলীয় হুইপ এবং সংসদে সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি আমাকে গত রাতে টেলিফোনে বলেন, ঝিকরগাছায় ৯৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি এবং চৌগাছায় ৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৬টি কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই করে সিল মারার ঘটনা ঘটেছে।
যশোরের নির্বাচনী তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান মো. জামাল হোসেন তদন্ত করে এর সত্যতা প্রমাণ পান। গতকাল তিনি ইসিকে দেওয়া চিঠিতে আইনি জটিলতার প্রসঙ্গ তোলেন। অথচ আজই তাঁর শেষ কর্মদিবস। তিনি ইসিকে জানিয়েছেন, সংক্ষিপ্ত বিচার পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত দণ্ড প্রদানের বিধান আছে। এখন তিনি কী করবেন। অথচ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৮৯-ক ধারা নির্দিষ্ট করে বলেছে, এই অপরাধের বিচার করতে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে না। অথচ তিনি এই বিষয়ে নির্দেশনা চেয়েছেন।
এই অপরাধের বিচার হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী দুই বেয়াইয়ের তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
এটা হোক। তাহলে আমরা আইনের শাসন দেখব। এটা হতে পারে না যে, আফিল উদ্দিন এবং তদন্ত কমিটি উভয়ে সঠিক। ইসি মনে করে এই অপরাধ আচরণবিধির অধীনে পড়ে না। সরকারি নথিতে লেখা হয়েছে, ‘নির্বাচনের দিন কেন্দ্র দখলের ষড়যন্ত্রকারী ৮৬ যশোর-১ আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জনাব আলহাজ শেখ আফিল উদ্দিন এবং অ্যাডভোকেট জনাব মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী তদন্ত কমিটি তাদেরকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৮৯-এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রদত্ত প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ব্যবহার করে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১২০বি (১) ধারাসহ পঠিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুচ্ছেদ ৮১ (১) (এফ) এ বর্ণিত অপরাধ ফৌজদারী কার্যবিধি এর ১৯০ ধারায় আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার সম্পাদন করতে পারেন।’
আফিল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। মুঠোফোনে বার্তারও উত্তর মেলেনি। অবশ্য তাঁর সম্পাদিত যশোরের দৈনিক স্পন্দন-এর সহকারী সম্পাদক গতকাল প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধির কাছে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন। স্বাক্ষরবিহীন ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, আফিল উদ্দিনের কণ্ঠ নকল করে ভিডিও করা হয়েছে। আমরা এই নির্বাচনী অপরাধের বিচার চাই।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
[email protected]