এরদোয়ান-মোদি মোলাকাতে 'কাশ্মীর-কাঁটা'

আরব দেশে জন্মালে তাঁর নাম হতো রজব তৈয়ব রিদওয়ান। তুর্কি ভাষায় তিনি হলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সম্প্রতি সামান্য ভোটে এগিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই তিনি বিশ্ব সফরে বেরিয়েছেন। প্রথম পা ফেলেছেন ভারতে; সেখান থেকে যাচ্ছেন রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে।

দেশ চারটির মধ্যে মিলের জায়গা হলো তিনটি দেশেই শক্তিমান রাষ্ট্রনায়ক, কারও কারও ভাষায় একনায়কের শাসনে চলছে। তুরস্কের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক মিলও চোখে পড়ার মতো। দুটি দেশই সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক দলের দ্বারা শাসিত। এ নিয়ে দেশ দুটির বিরোধীরা মোটেই স্বস্তিতে নেই। মোদির উত্থানও এরদোয়ানের মতো। এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের মেয়রের পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর মোদি ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় পদের আগে ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। দুজনই এক হাতে ধর্মের ডান্ডা আরেক হাতে সুপারপাওয়ার হওয়ার দাবি নিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। এবং দুজনই তাঁদের বিরোধীদের ‘দেশবিরোধী’ বলে বদনাম করে থাকেন। দুজনই ধর্মীয় অনুশাসনকে আইনে পরিণত করায় উৎসাহ দেখিয়ে থাকেন। দুটি রাষ্ট্রই যার যার প্রতিবেশীদের প্রতি ‘বড় ভাই’সুলভ আচরণ করে বলে প্রতিবেশীদের তরফে অভিযোগ আছে। মোদির বিরুদ্ধে দাঙ্গায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই। তবে এরদোয়ান কঠিন হস্তে বিরোধীদের দমন করেছেন, সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানচেষ্টার পর ৪০ হাজারেরও বেশি লোককে জেলে পুরেছেন, সিরিয়ায় আসাদবিরোধীদের সাহায্য করে থাকেন এবং কুর্দি বিদ্রোহীদের বিষয়ে তিনি খুবই কঠোর। দুটি দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে, তুরস্কের যেমন কুর্দিস্তান, ভারতের তেমনি কাশ্মীর।

এই কাশ্মীর নিয়েই চাপা মনোমালিন্য হয়ে গেল ভারত ও তুরস্কের। ভারতে সফরের ঠিক আগে আগেই এক সাক্ষাৎকারে এরদোয়ান বলেন, ‘কাশ্মীরে আর রক্তপাত হতে দেওয়া যাবে না। বহুস্তরীয় আলোচনার মাধ্যমে এর স্থায়ী সমাধানে আমরা আলোচনায় অংশ নিতেই পারি।’ ভারতের জন্য এ খুবই কর্দমাক্ত প্রসঙ্গ। এরদোয়ান এর আগে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার বৈঠকেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কথা তুলেছিলেন। দূরে বসে বলা এক বিষয়, কিন্তু যার বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি, তার ঘরের গুমর রাষ্ট্র করায় গেরস্তের গোস্‌সা হতেই পারে। অস্বস্তির সেই কাঁটা গিলেই প্রধানমন্ত্রী মোদি ও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি লালগালিচা বিছিয়ে এরদোয়ানকে বরণ করেছেন।

কথাটা এরদোয়ান এমন সময় বললেন, যখন পাকিস্তানি সেনারা ভারতীয় দুই সেনাকে হত্যা করে তাদের লাশ ছিন্নভিন্ন করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে ভারত। একই সময়ে পাঁচ ভারতীয় পুলিশকে হত্যা করেছে বিদ্রোহীরা। এর সমান্তরালে চলছে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ। এহেন অবস্থায় এরদোয়ান কেন কাশ্মীরের কথা তুলতে গেলেন?

তুরস্কের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানকে খুশি রাখার চেষ্টা? পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতার ইতিহাস অনেক পুরোনো। শুরু সেই ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে। উসমানিয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তুর্কি জনগণের লড়াইয়ের সময় বর্তমানের পাকিস্তানি এলাকা থেকে অর্থসাহায্য পাঠানো হতো। ষাটের দশকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেন্টো সামরিক জোটের গুরুত্বপূর্ণ দুই অংশীদার ছিল এই দুই দেশ। (১৯৫৭ সালে এই চুক্তির বিরোধিতা করে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে এসে ন্যাপ গঠন করেন। কারণ, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই চুক্তির পক্ষে।) বর্তমানে তুরস্ক ৪০ দেশের সমন্বয়ে গঠিত নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে (এনএসজি) পাকিস্তানকে ঢোকানোর অন্যতম তদবিরকারী। এদিকে ভারতও চায় এনএসজির সদস্যপদ। কথিত আছে, তুরস্ক এনএসজিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে। মোদি-এরদোয়ান দুজনই এনএসজির কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া থেকে বোঝা গেল পারমাণবিক প্রযুক্তির বরফ গলেনি।

তাহলে কেন এই সফর? ভারত আর তুরস্কের দূরত্ব কি কমছে?

তুরস্ক আর ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ভালো। ভারতের ব্যবসায়ীরা যেমন তুরস্কে বিনিয়োগ করেছেন, তেমনি তুরস্কেরও বিনিয়োগ রয়েছে ভারতে। এবারের সফরে ভারতের অবকাঠামো নির্মাণে তুরস্ক বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহী ছিল। তুরস্কের নির্মাণ ব্যবসা পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে ১৭তম বৃহৎ অর্থনীতির বিনিয়োগ সত্যিই চিত্তাকর্ষক। তুরস্ক ও ভারত এমনকি তৃতীয় কোনো দেশে যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে পারে বলেও এরদোয়ান প্রস্তাব রেখেছেন। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্বন্ধের চেয়েও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুরস্কের রয়েছে। দেশীয় ময়দানে এরদোয়ানের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে মার্কিনপ্রবাসী তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারীরা। তুর্কি কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেল, ভারতে ফেতুল্লাহ গুলেনের সংগঠন ছয়টি বিদ্যালয়, দুটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংস্থা, তিনটি ছাত্রাবাস এবং বেশ কয়টি কোম্পানি ও ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত। এরদোয়ান আশা করেছেন, ‘বন্ধু ভারত’ দেশটি থেকে গুলেনপন্থীদের দমাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।

বিনিময়ে তুরস্ক কী দেবে, সেটা দেখার অপেক্ষা। দুটি দেশ সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু সেই সহযোগিতা কোথায় হবে? ভারত আর দূরের দেশ হলেও একটি জায়গায় তাদের নিয়মিত দেখা হয়। সেটা হলো আফগানিস্তান। তালেবান বিরোধিতায় উভয়ে এক হলেও তুরস্ককে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের স্বার্থও দেখতে হয়। ২০১১ সাল থেকে তুরস্ক আফগানিস্তান বিষয়ে ‘ইস্তাম্বুল প্রসেস’-এর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। প্রথমবার ভারতকে এড়ালেও গত বছর কাজাখস্তানে এই প্রক্রিয়ার সম্মেলনে সভাপতি হয়েছিল ভারত। ভারত যেভাবে আফগানিস্তানকে পক্ষপুটে টেনে নিয়েছে, আফগানিস্তানে তাদের যে স্বার্থ রয়েছে, তা নিশ্চিত করায় যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি তুরস্কের হাতও তার ধরতে হবে। এর বাইরে দেশ দুটির সম্পর্ক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক মাত্রার বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেখা যাচ্ছে না।

এরদোয়ান-মোদির সাক্ষাতের তাৎপর্য এটাই, আন্তর্জাতিক স্বার্থের বেলায় ধর্ম, মতবাদ কোনো বিষয় নয়। এমনকি কাশ্মীর নিয়ে ‘অনভিপ্রেত’ মন্তব্য করার পরও ভারত যেভাবে এরদোয়ানকে সংবর্ধনা দিল, সেটাও বোঝায় স্বার্থের জন্য গলার কাঁটা গিলে ফেলা কোনো সমস্যা নয়। গলার কাঁটা উপেক্ষা করলেও তুর্কি-ভারত ঘনিষ্ঠতার পথের কাঁটা পাকিস্তানকে তো তারা কেউই উপেক্ষা করতে পারছে না। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে পাকিস্তান ভুলবে না, তুরস্ককেও তা ভোলাতে দেবে না। এই অবস্থায় নিকট-দূরত্বের প্রতিবেশীর সঙ্গে নিকট-দূরত্বের বন্ধুত্ব নিয়েই ভারতকে খুশি থাকতে হচ্ছে।