ভুল পথে এগোচ্ছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন

.
.

উন্নয়নশীল এবং মুসলিম বিশ্বে নারীদের অবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক অর্জন বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের একটি জনপ্রিয় মডেল। বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সব প্রতিবেশীকে অতিক্রম করেছি, যা কিনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান পরপর দুই বছর ধরে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার ওপরে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ১৪৪টি দেশের মধ্যে ৭২তম স্থানে ছিল, যখন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান ছিল যথাক্রমে ৮৭তম, ১০০তম, ১১০তম ও ১৪৩তম স্থানে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের ভর্তির ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। কেবল তা-ই নয়, শিশুদের টিকা গ্রহণের হার এবং শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে বাংলাদেশ। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক দিয়েও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের স্বল্প আয় এবং দারিদ্র্যের অপেক্ষাকৃত উচ্চহার বিচারে ওপরে উল্লেখিত সামাজিক অর্জনগুলো  বিস্ময়কর হলেও একদিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। আর সেটা হচ্ছে বাল্যবিবাহের উচ্চ হার।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে
সর্বোচ্চ। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দেশটি বর্তমানে ‘শিশু নববধূ মহামারি’তে ভুগছে। নারী এবং সামাজিক উন্নয়নে আমাদের থেকে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ এশীয় দেশ পাকিস্তানে মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার অপেক্ষাকৃত অনেক কম।

আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা এবং দেশব্যাপী সহস্রাধিক নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসব মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়, তাদের দেরিতে বিয়ে হওয়া মেয়েদের তুলনায় শিক্ষার অর্জন কম, পারিবারিক জীবনে নির্যাতনের ঝুঁকি অনেক বেশি। বাল্যবিবাহের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বাল্যবিবাহ ইস্যুতে গত তিন বছরে রাজনৈতিক পদক্ষেপ বেশ ইতিবাচক। বিশেষভাবে প্রশংসনীয় হলো ২০১৪ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে আন্তর্জাতিক গার্ল সামিটে বাংলাদেশ সরকারের বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার অঙ্গীকার। এ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার হ্রাসের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এরই সূত্র ধরে সরকার এ বছরে জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস করেছে, যাতে বাল্যবিবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তবে এই আইনে একটি বিশেষ বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে; যাতে বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আদালতের নির্দেশে ও বাবা-মা বা অভিভাবকের সম্মতি নিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে পূর্ববর্তী আইনেও বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ে করার আইনি অধিকার ছিল। সংস্কারকৃত নতুন আইন একই অবস্থান বজায় রেখেছে। কিন্তু পূর্ববর্তী আইনে বিশেষ অবস্থার বিধান দেওয়া হয়নি। কিন্তু নতুন আইনে বিধান রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিশু অধিকারসংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এটাকে একটি আত্মঘাতী এবং ভুল পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।

নারী ও শিশুবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান রেবেকা মমিন এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে বলেছেন যে ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ বিধান থাকলে শিশু বিয়ে বাড়বে না। তিনি জোর দেন যে গ্রামাঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে ‘বিশেষ বিধান’ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এখানে যে বিষয় উপেক্ষিত থাকছে তা হলো নতুন সংশোধিত আইন ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের নয়, বরং তাদের পিতা-মাতাকে আরও ক্ষমতা প্রদান করেছে। এটি উদ্বেগজনক এই কারণে যে এটি কেবল শিশুদের মতামত দানের অধিকারই নয়, বরং তার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসংক্রান্ত অধিকারগুলোও খর্ব করে। সুশীল সমাজ এবং শিশু বিশেষজ্ঞদের মতামতও এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে।

আমাদের মাঠপর্যায়ের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মেয়েশিশুদের বাল্যবিবাহ উচ্চহারের কারণ বহুবিধ—যেমন নারীর নিম্ন সামাজিক অবস্থা, দারিদ্র্য এবং নারীর বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা–সংক্রান্ত উদ্বেগ। এসব কারণে ভারত, মোজাম্বিক, মালাওয়ি, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও উগান্ডার মতো দেশগুলো বাল্যবিবাহের জন্য হট স্পট। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালেও বাল্যবিবাহ একইভাবে একটি সামাজিক ব্যাধি, যদিও কি না বাংলাদেশের মতো নেপালের নারীরা ভারত ও পাকিস্তানের থেকে নানা দিক
দিয়ে এগিয়ে রয়েছে। নেপালে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতার বিচারে
এবং শিক্ষাগত অর্জনের সূচকের অগ্রগতি সাপেক্ষে গত এক দশকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে নেপাল। তা
সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ হ্রাসের ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা গবেষণা করে যেই চিত্র প্রতীয়মান তা হলো এই সামাজিক সমস্যার একক কোনো সমাধান নেই। কিন্তু সদ্য পাস করা বাল্যবিবাহ আইনে ‘বিশেষ অবস্থার’ সংযোজনের বিষয়টা একেবারেই ব্যতিক্রম, উদ্ভট এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি সরকারের জনমুখী রাজনীতিকেও অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশে বিয়ের সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয় চরম দারিদ্র্য এবং নিরক্ষর সামাজিক প্রেক্ষাপটে। একটি পরিবারকে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো (যেমন যৌতুকের খরচ) তাড়িত করে, অন্যদিকে আবার সামাজিক এবং ধর্মীয় রীতিনীতি বিবেচনায় নিতে হয়। তাই এ ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম বয়সী বিয়ের ব্যতিক্রমমূলক আইনি বিধান বাল্যবিবাহ বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করে।

যেসব উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেশি, সেসব দেশের মধ্যে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের একটি আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে গেছে। সমস্যা-জর্জরিত বাকি উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় প্রাথমিক ধারার কর্মসূচিগুলো (যেমন কিশোর-কিশোরীদের আত্ম-উন্নয়ন, আইনি শিক্ষা, মানসিক ক্ষমতায়ন) আমাদের দেশে অনেক বেশি কার্যকর হবে। কেননা নারী উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সামগ্রিক অর্জন একটা অনুকূল প্রবেশ সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছি যে সদ্য পাস করা বাল্যবিবাহ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং এ নিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে বিভাজন, এই সমস্যা মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি লড়াইকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে এবং অন্যান্য প্রাথমিক ধারার কর্মসূচির ওপরও তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এ জন্য যেটা এখন বেশি প্রয়োজন সেটা হলো ধর্ম-গোত্রনির্বিশেষে একটি সর্বজনীন আইন প্রণয়ন এবং কিশোর-কিশোরীবান্ধব প্রতিরোধ কৌশল। এই কৌশলগুলো বাল্যবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনবে।

সাজেদা আমিন: সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট, পপুলেশন কাউন্সিল, নিউইয়র্ক।

ম নিয়াজ আসাদুল্লাহ: অধ্যাপক (উন্নয়ন অর্থনীতি), মালায়া ইউনিভার্সিটি, কুয়ালালামপুর এবং ভিজিটিং ফেলো, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি।

সারা হোসেন: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং পরিচালক (অবৈতনিক), ব্লাস্ট।

জাকী ওয়াহাজ: সিনিয়র লেকচারার (অর্থনীতি), কেন্ট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।