অবরোধ ভাঙার দিশারি

সুফিয়া কামাল: জন্ম ২০ জুন ১৯১১, মৃত্যু ২০ নভেম্বর ১৯৯৯
সুফিয়া কামাল: জন্ম ২০ জুন ১৯১১, মৃত্যু ২০ নভেম্বর ১৯৯৯

আষাঢ় এসেছে। কদম ফুল ফুটছে গাছে গাছে। সুফিয়া কামালের প্রিয় ফুল জন্মদিনের অর্ঘ্য সাজিয়ে আমাদের মনে বেদনার-আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে। জুন মাসের ২০ তারিখ তাঁর ১০২তম জন্মদিন। ২০ নভেম্বর তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন। আর কটা দিন তাঁকে সুস্থ-সুস্বাস্থ্যে পেলে আমরা তাঁর স্বপ্ন পূরণ হতে দেখতাম। তিনি একুশ শতকের প্রথম সূর্যের আলো দেখার আনন্দ পেতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, একুশ শতক নতুন যুগের জাগরণ ঘটাবে এই বাংলায়।অবরোধ তিনি দেখেছেন জন্মের পর থেকেই। শায়েস্তাবাদের (বরিশাল) নওয়াব নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম, বড় হওয়া। জমিদারবাড়ি—নবাববাড়ির আভিজাত্য একদিকে যেমন প্রাচুর্যে ভরে দিয়েছিল, তেমনি বিশাল প্রাচীরের ভেতর বিরাট ভবনে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। পুরুষের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল অন্দরবাড়িতে।নবাববাড়ির নিজেদের মসজিদে শিশু সুফিয়া ‘আমপারা’ পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সাত বছর বয়স হলেই মেয়ে বলে মসজিদে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অন্দরবাড়িতে মায়ের কাছেই তাঁর কোরআন পাঠ সম্পন্ন হলো। স্কুলেও যাওয়া হয়নি ‘মেয়ে বয়স’ শুরুর পর। ভাইদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার বায়না করেছেন। ছেলেদের মতো পাজামা-আচকান-টুপি পরে ভাইদের সঙ্গে কিছুদিন স্কুলে গেলেন। ভাইয়েরা শহরে পড়তে গেলেন। তাঁর স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেল অববোধের কারণে।সে তো ছিল সমাজ মানসিকতার অবরোধ। ভাইয়েরা সেই অবরোধের দেয়াল ভাঙতে পারেননি কিন্তু শহর থেকে বোনকে পাঠাতেন সন্দেশ পত্রিকা। বানান করে করে মায়ের কাছে পড়তেন তিনি। মেয়ের নামে ডাকে বই আসাও ছিল ঘোর অবরোধের মানা। বড় মামা নিজেই ছিলেন এই অবরোধের প্রতিভূ।সুফিয়াকে এই বাধা ডিঙাতে মা, পণ্ডিত প্যারীলাল বাবু সাহায্য করেছেন। বাংলা শিখে পড়তে থাকলেন মামার লাইব্রেরির বই নজরুলের ‘হেনা’ ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা। সেও তো লুকিয়ে লুকিয়ে। তিনি সব অবরোধ ছিন্ন করে, ভেঙে দিয়ে গল্প লিখলেন, পত্রিকায় ছাপালেন, সহযোগিতা পেলেন প্রগতিবাদীদের, পরিবারের স্বামী, মা, ভাইয়ের। ছাপানো গল্প দেখে মামা সুফিয়াকে নজরবন্দী করে রাখলেন। এই বাধা ভেঙে সুফিয়া এগিয়ে গেলেন, কবিতা লিখলেন, কবিতা ছাপালেন, সওগাত মহিলা সংখ্যায় ‘ছবি’ ছাপালেন। সামাজিক-পারিবারিক অবরোধ ভেঙে ভেঙে সাহসী হলেন তিনি। সেই সাহস নিয়েই বৃহত্তর সামাজিক অবরোধ ভাঙতে মেয়েদের সাহসী করলেন, নারী সংগঠনের সংগঠক হলেন, নেত্রী হলেন, মানবাধিকার নেত্রী হলেন।

সুফিয়া কামাল বলেছেন, তাঁর আশৈশব জীবনের কথা একালে আমাদের কাল বইটিতে: ‘আমরা জন্মেছিলাম পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, ...স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই, এই বাণী তখনকার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হত। এখনও মানুষ সেই সংগ্রাম করে চলেছে, একতাবদ্ধ গণজাগরণ চিরকাল জয়ের পতাকা উড্ডীন করেছে।’ তাঁর পুরো জীবন কেটেছে গণজাগরণের জয়ের পতাকা হাতে। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবরোধকে ভেঙে গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে তিনি ১২ বছর বয়স থেকে আজীবন পথ চলেছেন। সহযাত্রী এবং উত্তরসূরিদের পথ দেখিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। সব ধরনের অবরোধ ভেঙে ব্যক্তিগত ও সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলন করতে এগিয়ে দিয়েছেন।

১৯২৪-২৫ সালে কিশোরী সুফিয়া বোরকা পরে বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে বরিশালে সাবিত্রী দত্তের সঙ্গে গিয়েছেন মহিলা সমিতির সভা করতে। অদম্য আগ্রহ নিয়ে সেই সময়েই মহাত্মা গান্ধীর হাতে দিয়েছেন চরকায় কাটা সুতা। কলকাতায় ১৯২৭-২৮ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ সমিতির বহু কর্মকাণ্ডের সংগঠক ছিলেন। অল ইন্ডিয়া উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের বহু কাজে সক্রিয় ছিলেন ১৯২৫-২৯ সময়কালে। কাব্যচর্চা চলেছে, এক মেয়ের মা হয়েছেন, অবরোধের পর্দা বারবার শিকলের মতো পায়ে বেড়ি দিতে চায়, সেই সংকোচ-সংকট ভেঙে ১৯২৬ সালে যোগ দিলেন নিখিল-ভারত কংগ্রেসের অধিবেশনে। সেখানে লেডি অবলা বসু, সরলা দত্ত, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ছিলেন। সাহস পেয়েছেন, অবরোধ ভেঙেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করলেন কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সেখানেই দেখা পেয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসুর। ডাক পেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে যাওয়ার। বলেছেন তিনি: ‘কিন্তু তখন কি আমার সে অবরোধ ঘুচিয়ে যাবার উপায় ছিল? বন্দিনী খাঁচার পাখীর শুধু পাখা ঝাপটানোই সার হয়েছে। বাঁধার পর বাঁধা। কত যে নিগড় ভেদ করে এ জীবন মুক্তি লাভ করতে চেয়েছে।’

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটালেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ব্যক্তিগত পর্দা, ‘বোরকা’র আবরণ থেকে বেরিয়ে এলেন বৃহত্তর ‘অবরোধ’ মুক্তির সোপান তৈরির জন্য।

বর্ধমানে মুসলিম নারীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন ১৯৪২-৪৩-এ। নিগড় ভাঙা শুরু করলেন। বেগম পত্রিকার সম্পাদক হলেন। সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গাবিরোধী (১৯৪৬) কর্মকাণ্ডে যোগ দিলেন। ঢাকায় এলেন দেশভাগের পর ১৯৪৭-এ। একের পর এক কর্মকাণ্ডে তিনি যোগ দিলেন লীলা নাগ (রায়)-এর সঙ্গে, কামরুল হাসান, নিবেদিতা নাগ, যুঁইফুল রায়, আনোয়ারা খাতুন, দৌলতুন্নেসা, আরও বহুজনের সঙ্গে কাজের ব্যাপকতায় ভাঙতে থাকলেন নিজের ওপর চেপে বসা ‘অবরোধ’, সমাজ-দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবরোধ।

ভাষা আন্দোলনের মিছিলের ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুই শিশুকন্যা কোলে (সুলতানা-সাইদা কামাল)। মহিলাদের অধিকার বিষয়ে ওলেমা বোর্ডের বক্তব্য ছিল পাকিস্তানের মূলনীতি রিপোর্টে। নারীদের ঘরের বাইরে কাজের বিরুদ্ধে তৎকালীন ওলেমা বোর্ডের বক্তব্যের বিরুদ্ধে নারীনেত্রীদের যুক্ত বিবৃতিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে বলেন (১৯৫৩): ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সম্বন্ধে সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হয়েছে। এর ফলে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নীতি উৎপাটিত হবে।’

পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকজুড়ে তিনি তাঁর সহযোগী, সহযাত্রী এবং উত্তরসূরিদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে একইভাবে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছেন।

পারিবারিক আইন (১৯৬১) তৈরির জন্য সমকালীন নারীনেত্রীদের, সংগঠকদের নিয়ে সুফিয়া কামাল রাজনৈতিক-ধর্মান্ধদের অবরোধের বাধা ভেঙেছেন। সেই আইনটিরও এখন সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সেই সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। এখনো দেশের কোটি কোটি নারীকে পারিবারিক আইনের বৈষম্য-অসাম্য-নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। সারা জীবন সুফিয়া কামাল এই আইনের সাম্যনীতির জন্য সংগ্রাম করেছেন। উত্তরসূরিরাও আন্দোলন করছেন। বাধা হিসেবে ‘পুরুষ’ সুবিধাভোগীদের অবরোধ রাষ্ট্রীয় অবরোধের সহায়ক হয়ে আছে।

ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকের গণবিরোধী প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সহমর্মিতায়, শিশু-কিশোর-নারী-পুরুষ-সংস্কৃতিসেবীদের অধিকারের দাবিতে তিনি দাঁড়িয়েছেন আপসহীন কান্ডারি হিসেবে। তাঁকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ভেতরে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ও গেরিলা যোদ্ধাদের সহায়তার জন্য গোপন যোগাযোগব্যবস্থা। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে নির্যাতিত নারীদের তিনি বলেছেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের ভেতরে নিজ বাড়িতে থেকে নয় মাস যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি সেনাদের অষ্টপ্রহর নজরবন্দী অবস্থায়। স্বাধীনতার পরও চলেছে রাজনৈতিক-সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। নব্বইয়ের গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্বে নারীর রাজনৈতিক সম-অধিকারের সংগ্রাম তীব্রতর হয়েছিল। জীবনের শেষ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধেও বলেছেন তীব্রভাবে।

মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সামরিক শাসনের গণবিরোধী একনায়কত্বের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন। জনগণের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনকে অবরুদ্ধ করে রাখার যে প্রয়াস রাষ্ট্রীয়ভাবে অব্যাহত রয়েছে, তার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন রাজপথে।

একুশ শতকের শুরু থেকেই পঞ্চাশের দশকের নারীর সম-অধিকারবিরোধী ধারার পুনরুত্থানের ঘটনা তীব্রভাবে ঘটে চলেছে। ঘোষিত ‘নারী উন্নয়ন নীতি’র বিরুদ্ধে অযৌক্তিক মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে। অতিসম্প্রতি সেই রকমই আওয়াজ তুলেছে হেফাজতের সংগঠনের ১৩ দফা।

সুফিয়া কামালের প্রতিবাদী রক্ত আমাদের শোণিতে শোণিতে প্রবাহিত। তাঁর জন্মদিনে সেই প্রতিবাদ গর্জে উঠছে নারীর সম-অধিকার বিরোধিতার সব সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে।

সমগ্র সংস্কৃতিমনা সমাজ, প্রগতিবাদী রাজনীতিবিদ-রাজনীতিসচেতন সমাজকে অবরোধের প্রতিবাদে যুক্ত হতে বলেছেন কবি সুফিয়া কামাল। আজীবন তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যে, অবরোধ শুধু নারীর জীবনকে বিনাশ করছে না, সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতিকে গ্রাস করছে। দেশ স্থবির কূপমণ্ডূকতায় নিমগ্ন হচ্ছে। সবাইকেই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।

রোকেয়া সাখাওয়াতের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি বলেছেন, সমাজের এক অঙ্গ বিকল হলে সমাজ চলবে কীভাবে? নারীর বিরুদ্ধে অবরোধ তো শুধু অর্ধাঙ্গের বিরুদ্ধে অবরোধ নয়; সে তো পুরুষ সমাজসহ পুরো সমাজের বিরুদ্ধে অবরোধ। অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে নারীকে অবরোধ ঠেলে, সংস্কৃতি কূপমণ্ডূক হয়ে যাচ্ছে নারীকে নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে; রাজনীতি কলুষ হয়ে উঠেছে নারীর বিরুদ্ধে হীন ধর্মান্ধ রাজনীতির ঘোষণা দিয়ে।

ব্যক্তিগত অবরোধ মুক্তির সংগ্রামকে সবার অবরোধ মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেই তাঁর জীবন ফুল্লকুসুমিত হয়ে উঠেছে।

এখনই সেই সময়, যখন সুফিয়া কামালের আদর্শ অনুসরণ করে দেশের নারী-পুরুষ প্রগতিবাদীদের এক মঞ্চে সমবেত হয়ে ধর্মান্ধ-পশ্চাৎমুখী অবরোধকে রুখে দাঁড়াতে হবে। হুঁশিয়ারি দিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা ভেঙে গুঁড়িয়ে সমান অধিকারের সহযাত্রার মসৃণ পথ তৈরি করতে হবে। সুফিয়া কামালের জন্মদিন সেই আদর্শের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।

মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।