এটি কি অন্তর্বর্তী সরকার নয়?

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ যত কথাই বলুক না কেন, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলে ভোটের দিনের যে বিবরণ ও ছবি প্রচারিত (প্রকাশিত) হয়েছে, তাতে এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলার সুযোগ নেই। ভোটের আগেই ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচন আগেই কলঙ্কিত হয়েছে। তবে ৫ জানুয়ারি ৪২টি কেন্দ্রে যে একজন ভোটারও ভোট দিতে আসেননি, তাতে
এই নির্বাচনের স্বরূপ আরও উন্মোচিত হয়েছে। আগে থেকেই বলা হয়েছিল, এই নির্বাচন হবে প্রহসনের নির্বাচন। ৫ জানুয়ারি সরকার গায়ের জোরে ‘পোকা খাওয়া’ নির্বাচন করে তা ভালোভাবে প্রমাণ করেছে। ভারত ছাড়া আর কোনো বিদেশি রাষ্ট্র, সরকার, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত এই নির্বাচন মেনে নিতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন যতই ভোট প্রদানের হার ৪০ শতাংশ দাবি করুক না কেন, তা জনগণ বিশ্বাস করছে বলে মনে হয় না। যাঁরা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্র দেখেছেন বা টিভিতে লাইভ দেখেছেন, তাঁদের অনেকের ধারণা, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।
ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ দলের সরকারকে বৈধ বলার সুযোগ নেই। বিএনপি, জামায়াত বা অন্যান্য দল এই নির্বাচন ও সরকারকে কীভাবে দেখবে, সেটা তাদের সমস্যা। আমরা নির্দল নাগরিক সমাজ এই ‘সরকারকে’ কীভাবে দেখব, তা নিয়ে একটা আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ, এই নির্বাচন গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করেছে। সরকার অতীব শক্তির অধিকারী বলে তাদের সব অন্যায় কাজ মেনে নেওয়া যায় না। আজ্ঞাবহ ও মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনও জনপ্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই তাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের নির্দল নাগরিক সমাজ এই নির্বাচন ও সরকারকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে, তা নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা হওয়া খুব জরুরি। এটা এ জন্য প্রয়োজন যে, এই দেশ শুধু দুই প্রধান দলের দেশ নয়। নির্বাচন মানে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ। দলীয় স্বার্থে একদল ১৫৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করাবে, আরেক দল ভোটের দিন ব্যাপক সহিংসতা করবে, সেই সহিংসতা সরকার দমন করতে পারবে না, এসব মেনে নেওয়া যায় না। দুই বড় দল মিলে নির্বাচনকে প্রহসন ও ভীতিকর করে তুলেছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে একমাত্র বড় ভরসা হয়ে দেখা দিয়েছে জাতিসংঘ এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলো। তাদেরকে সরকার জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি বলে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছে, এসব বুলি হলো: ছলে-বলে-কৌশলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। সরকারের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ হলো রাজনৈতিক কৌশল। আওয়ামী লীগের বাইরেও বিএনপি, জেএসডি, বাসদ, সিপিবি, গণফোরাম ও আরও বহু দল রয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে।
বাংলাদেশের বহু সচেতন মানুষ তা জানেন। সুষ্ঠুভাবে ভোটের আয়োজন করার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধ নেই। সুষ্ঠুভাবে ভোটের আয়োজন করলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা যাবে না, এমনও নয়।
কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, জঙ্গিবাদ ইত্যাদি ধুয়া তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজি হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে, তা কে বলেছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটও হয়তো ক্ষমতায় আসতে পারত। পারত না?
বিএনপি ও অন্যরা যে দুই বছর যাবত বলেছে: ‘দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হলে তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে না’—তা ৫ জানুয়ারি কি আবার প্রমাণিত হয়নি? আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তা আমূল পরিবর্তন না হলে, আরও পাঁচটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা প্রয়োজন হতে পারে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এই দাবি আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের টিভি ফুটেজ এবং ৬ তারিখের পাঠকপ্রিয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও ছবি একটা ডকুমেন্ট হিসেবে এখনই সংকলন করা উচিত। তা অনাগত দিনে নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বারবার দেখাতে হবে। এই নির্বাচন হলো এক বিষণ্ন দলিল।
আমাদের সৌভাগ্য, বন্ধুরাষ্ট্রের সরকারগুলো এই বাস্তবতা দ্রুত উপলব্ধি করতে পেরেছে। ভারত পারেনি, তার কারণ ভিন্ন। জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইইউ, জাপান, চীন, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য, কানাডা, বিশ্বব্যাংক—এসব দেশের (ও সংস্থার) সঙ্গে ব্যবসা, জনশক্তি, গার্মেন্টস, শান্তিরক্ষী বাহিনী ও বাংলাদেশের অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে।
এখন শেখ হাসিনার সরকারকে ঠিক করতে হবে যে, তাদের সহায়তার প্রয়োজন আছে কি না? জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইইউ, জাপানসহ অন্য বহু দেশ ইতিমধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নে তাদের বার্তা জানিয়ে দিয়েছে।
সরকার কী করবে, তা তারা ভালো জানে। আশা করি, ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে তারা যে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, সে রকম কাজ আর করবে না। এখন তাদের অনেক ভেবেচিন্তে প্রতিটি চাল দিতে হবে। সরকার যেন মনে রাখে, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়।
নতুন ‘নির্বাচিত’ সরকার সম্পর্কে নির্দল নাগরিক সমাজকে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে, তাদের ভূমিকা কী হবে। আমার মত হলো: এই সরকারকে পুরোপুরি স্বীকার করলে ভোটের প্রহসন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না দেওয়াটা প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হবে। দুই বড় দল একবার ভোটারবিহীন নির্বাচনের মজা পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে আর ভোটারদের মান্য করবে না। ছলে-বলে-কৌশলে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বাড়ির সামনে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরোধ করে ভোটারবিহীন নির্বাচনপর্ব সেরে ফেলতে পারে। এটা কিছুতেই ‘নির্বাচনের’ মডেল হতে পারবে না।
এই নির্বাচন ও ‘নির্বাচিত সরকার’ একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে এটা দুই বড় দলের কাছে (যার যার সুবিধামতো) একটা দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে। এটা ভাবা যায়? কী ভয়ংকর মডেল হতে যাচ্ছে? কাজেই, এই নির্বাচন ও সরকারকে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না।
নাগরিক সমাজ না মানলে সরকারের কী এসে যায়? ঠিক, কিছুই এসে যায় না। এখন হয়তো কিছুই এসে যাবে না। ভবিষ্যতে যাবে। তার জন্য নাগরিক সমাজকে কিছু কাজ করতে হবে। তার আগে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে, এই নির্বাচন ও সরকারের মূল্যায়ন কী হবে?
আমরা মনে করি, এই প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হবে, অনতিবিলম্বে সব নিবন্ধিত দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা, যাতে দ্রুততম সময়ে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যায়। আলোচনার জন্য কোনো পক্ষের পূর্ব শর্ত আরোপ করা ঠিক নয়। তবে এবার আলোচনার আগে দুই পক্ষকে ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু দুই দল নয়, নিবন্ধিত সব দলের সঙ্গে সরকারকে আলোচনা করতে হবে। সবার মতামতই মূল্যবান।
প্রধানমন্ত্রী সহিংসতা বন্ধের জন্য বিএনপিকে যে শর্ত দিয়েছেন, তা-ও ঠিক বলে মনে করি না। সহিংসতা যে দলই করুক না কেন, তা কঠোর হাতে দমন করা সরকারের দায়িত্ব। আমরা চাই, সরকার তার বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সব রকমের সহিংসতা দমন করবে।
তবে এই অভিযানে যেন নিরীহ মানুষ শাস্তি না পায়, তা দেখা দরকার। সহিংসতা দমনে কোনো আপস হতে পারে না। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারেও সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটা সবারই প্রত্যাশা।
প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ‘সরকারকে’ আমরা পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সরকারের গদি তো আর শূন্য থাকতে পারে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।